আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি

আঙ্গুর চাষ কিভাবে করবেন? আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি একনজরে জেনে নিন!

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি : আঙ্গুর হচ্ছে অতীব জনপ্রিয় একটি ফল। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই এটি খুবই জনপ্রিয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আঙ্গুরের বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। যদিও আমাদের দেশে আঙ্গুরের চাহিদার পুরোটাই আমদানি করতে হয়। 

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি

ইতিহাস 

আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলে আঙ্গুরের প্রথম চাষ শুরু হয়। আঙ্গুরের ইংরেজি নাম হলো Grape. এটি এমন এক ধরনের ফল যা লতা জাতীয়  দ্রক্ষ্যলতা গাছে ফলে থাকে। একটি থোকায় কমপক্ষে ৬ থেকে ৩০০ টি পর্যন্ত আঙ্গুর ধরে থাকে। 

আঙ্গুর বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে কালো, নীল, সবুজ, সোনালী, বেগুনি, লাল, সাদা ইত্যাদি। পাকা আঙ্গুর সরাসরি খাওয়া যায়, আবার এটি রস, ভিনেগার, জেলি, মদ ও তেল বানিয়েও খাওয়া যায়। 

মূলত আঙ্গুর শুকিয়ে কিসমিস তৈরি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের যেসব দেশে আঙ্গুর বেশি চাষ করা হয়ে থাকে সেগুলো হলো তুর্কি, দক্ষিণ আফ্রিকা, চিলি, ইতালি, ইরান, আর্জেন্টিনা  ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পর্তুগাল ইত্যাদি। 

আঙ্গুর 

আঙ্গুর বিভিন্ন কালারের হয়ে থাকে কালো, সবুজ, বেগুনি, লাল, সাদা, সোনালী ইত্যাদি। আঙ্গুর ফলের একটি বিশেষ গুণ আছে তা হলে এটি শুকিয়ে কিসমিস করা হয়। 

এই কিসমিসে যদি আমাদের শখের খাবার গুলোতে না থাকে তাহলে খাবারগুলো একেবারেই বেমানান হয়ে যায়। এই ফলে বিদ্যমান খনিজ পদার্থ আমাদের শরীরের জন্য বেশ কার্যকর।

জমি ও মাটি নির্বাচন 

দো-আশঁযুক্ত লালমাটি, জৈব সার সমৃদ্ধ কাকঁর জাতীয় মাটি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আবার পাহাড়ের পাললিক মাটিতে আঙ্গুর চাষ ভালো হয়। আঙ্গুর চাষের জন্য জমি এমনভাবে বাছাই করতে হবে, যেটা অবশ্যই উঁচু হতে হবে যেখানে বর্ষার পানি জমে থাকবে না। 

জমি এমন হতে হবে যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময় সূর্যের আলো পড়ে। দোআঁশ যুক্ত লালমাটি আঙ্গুর চাষের জন্য উত্তম। মাটিতে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব পদার্থের উপস্থিতি থাকে সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। 

আঙ্গুর চাষের ক্ষেত্রে আদর্শ জলবায়ু হলো ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আঙুর গাছের খুব ভালো বৃদ্ধি ঘটে। 

টবে চাষের ক্ষেত্রে 

রাজাবাজার আঙ্গুর চাষের জন্য আপনি ছোট টবা পাত্র ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়াও আঙ্গুর চাষের জন্য আপনি মাঝারি সাইজের টপ অথবা বড় বোতল অথবা অন্য যে কোন পাত্র ব্যবহার করতে পারবেন।

আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী বাড়ির উঠোনে মাচা তৈরি করে আঙ্গুরের চাষ আবাদ করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে জায়গাটা যেন রোদ্রউজ্জল হয়।

আঙ্গুরের জাত 

সাধারণত আমাদের দেশে তিন জাতের উৎপাদনশীল আঙ্গুর চাষ করা হয়ে থাকে। ব্ল্যাক রুবী, জাককাউ ও ব্ল্যাক পার্ল ইত্যাদি। এগুলো সবই গৃষ্মকালীন জাত কিন্তু পরবর্তীতে ৩ টির রং রূপান্তরিত হয়ে থাকে যথাক্রমে কালো, বাদামি ও করমচা ইত্যাদি রং ধারণের মাধ্যমে। 

এছাড়াও আরো অন্যান্য ছাত্র হয়েছে সেগুলো হলোঃ- 

বীজযুক্ত জাত – কার্ডিনাল, কনকর্ড সম্রাট, ইতালি, আনাব-ই-শাহী, চিমা সাহেবী, কালিসাহেবী, রাও সাহেবি,

বীজহীন জাত – থম্পসন বীজহীন, শিখা বীজহীন, কিশমিশ চোর্নি, পার্লেট, আরকাবতী।

রোপণের উপযুক্ত সময় 

সাধারণত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রোপণ করা ভালো। আবার জুন-জুলাই মাসেও রোপণ করা যায়, যখন বর্ষা পরিপূর্ণ ভাবে থাকে।

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি তে জমি তৈরি 

জমিকে ভালোভাবে কয়েকটি চাষ দিতে হবে। এরপর মই দিয়ে জমির মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। তারপর ৭০×৭০×৭০ সেন্টিমিটার হারে গর্ত তৈরি করে, সেখানে যথাক্রমে গোবর ৪০ কেজি, পটাশ ৪০০ গ্রাম, ফসফেট ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া ১০০ গ্রাম  গর্তের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১০/১৫ দিন রেখে দিতে হবে। 

১৫ দিন পর সারগুলো মাটিতে ভালোভাবে মিশে গেলে, গর্তের মধ্যে হালকা সেচ দিয়ে সক্রিয় চারা রোপণ করে দিতে হবে। আঙ্গর গাছ মাচায় ওঠা পর্যন্ত প্রধান কান্ড ছাড়া অন্য সকল শাখা প্রশাখা গুলো ভেঙে দিতেই হবে। 

বপন পদ্ধতি 

Root cutting পদ্ধতিটা ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে হয়ে থাকে। চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৩/৫ মিটার এবং গভীরতা হবে ১ মিটার। 

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি তে সার প্রয়োগ 

আমি জানি আঙ্গুর মূলত লতানো গাছে তাই এর বৃদ্ধির জন্য সময়মতো বাড়তি সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের একমাসের মধ্যে গাছের বৃদ্ধি ভালো না হলে, গোড়ার মাটি আলগা করে সেখানে ৫ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। 

আবার ১/৩ বছরের প্রতিটি গাছে বছরের গোবর ১০ কেজি, পটাশ ৪০০গ্রাম, ফসফেট ৪৫০ গ্রাম,  ইউরিয়া ১৫০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। পটাশ সার আঙ্গুরের জমিতে প্রয়োগ করার ফলে আঙ্গুর মিষ্টি হয় এবং রোগ-বালাইয়ের উপদ্রব কমে যায়। 

আরে বয়স্ক কাজগুলোর জন্য প্রতিবছর ঠিক এপ্রিল মাসে ২ কেজি তেলের খৈল, ১ কেজি হাড় চূর্ণ ও ২৫০ গ্রাম সালফেট অফ পটাশ ব্যবহার করতে হবে। এপ্রিল মাসে যখন গাছের ফল আসবে তখন ২ বার ইউরিয়া সার স্প্রে করতে হবে। 

অভ্যন্তরীণ পরিচর্যা 

রোপণ করার এক বছর পরে আঙ্গুর গাছ কি মাচায় দিতে হবে। তারপর ফেব্রুয়ারি মাসে মাচায় ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুর গাছের কান্ড ছোট করে ছেটে দিতে হবে। সঠিক নিয়ম মেনে কান্ড ছাঁটাই করলে আঙ্গুরের ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়। 

ছাঁটাই করার ফলে ফুল ঝরে পড়ে না। ছাঁটাই করার এক সপ্তাহ আগে এবং পরে গাছের গোড়ায় সেচ দিতে হবে। গাছ রোপনের পর থেকে মাচায় উঠা পর্যন্ত মূল শাখা ব্যতিত পার্শ্ববর্তী সবগুলো শাখা ছেঁটে ফেলতে হবে। 

১ম ছাঁটাই 

মাথায় কান্ড ওঠার পরে ৩৫-৪৫ সেন্টিমিটার হলে প্রধান কান্ডের শির্ষ অংশ ছেঁটে ফেলতে হবে। যেন কান্ডের দুদিক থেকে ২টি করে মোট ৪টি নতুন শাখা গজায়। 

২য় ছাঁটাই 

১ম ছাঁটাইয়ের পর গজানো ৪টি শাখা বড় হয়ে গেলে ১৫/২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে এর চারটি মূল শির্ষ কেটে দিতে হবে। যাতে কান্ডের দুদিক থেকে ২টি করে মোট ১৬ টি প্রশাখা বের হয়। 

৩য় ছাঁটাই 

আবার এই ১৬ টি প্রশাখা ১৫/২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে আবার এদের মূল শির্ষ কেটে দিতে হবে। এভাবে আবার আগের মত ১৬ টি শাখা থেকে মোট ৬৪ টি শাখা বের হবে। পরবর্তীতে কিছুদিনের মধ্যে গাছে ফুল আসবে তারপর ফল ধরবে। 

রোগ দমন ব্যবস্থাপনা 

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি তে রোগ দমন ব্যবস্থাপনা একটি অতীব জরুরী বিষয়। মূলত আঙ্গুর গাছে যেসব পোকা আক্রমণ করে সেগুলো হলো থ্রিপস এবং জ্যাসির, গুবরে পোকা, পত্র মর্দনকারী পোকা বা লীফ রোলার, লাল ও হলুদ বোলতা ইত্যাদি। 

উপরোল্লিখিত পোকাগুলো থেকে আঙ্গুর বাগান কে মুক্ত করতে হলে অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব পোকামাকর নিয়ন্ত্রণে যেসব বালাইনাশক ব্যবহার করবেন সেগুলো হলোঃ- ডাউনি মিলিডিউ, পাউডারি মিলিডিউ, এনথ্রাকনোস ইত্যাদি। রসুন চাষ কিভাবে করবেন? রসুন চাষ পদ্ধতি একনজরে জেনে নিন!

ফসল সংগ্রহ 

মূলত আঙ্গুর ফল যখনই পরিপক্ক ভাবে পাকে তখনই সংগ্রহ করতে হবে। যদি এপ্রিল-মে মাসে ফুল দেখা যায় তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পুরোপুরিভাবে আঙ্গুর ফল পেকে যাবে। 

সাধারণত আঙ্গুর ফল গৃষ্মকালে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন আঙ্গুর ফল পাকতে পাকতে বর্ষাকাল চলে না আসে। বর্ষাকালে আঙ্গুর ফল পাকলে ফলের মিষ্টি থাকে না। 

আঙ্গুর ফলের পুষ্টিগুণ 

আঙ্গুর ফলের রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান। যেমনঃ ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও জিংক ইত্যাদি। 

আমাদের সুস্থতা বজায় রাখতেই পুষ্টি উপাদানগুলো খুবই কার্যকরী। 

প্রতি ১০০ গ্রাম আঙ্গুর ফলে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা হলঃ- 

শর্করা১৮.১ গ্রাম
স্নেহ০.১৬ গ্রাম
প্রোটিন০.৭২ গ্রাম
ভিটামিন বি১০.০৬৯ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি২০.০৭ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৩০.১৮৮ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি৩.২ মিলিগ্রাম
ভিটামিন ই০.১৯ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম১০ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম৭ মিলিগ্রাম
পটাশিয়াম১৯১ মিলিগ্রাম
ফসফরাস২০ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম২ মিলিগ্রাম
ম্যাঙ্গানিজ০.০৭১ মিলিগ্রাম
জিংক০.০৭ মিলিগ্রাম
আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে আঙ্গুর চাষের সম্ভাবনা 

যেহেতু আমাদের দেশে আঙ্গুরের যতটুকু চাহিদা আছে তার সবটুকুই আমদানি করতে হয়। এই ফলটি  অতীতেও বাংলাদেশের চাষ করা হয়নি এবল বর্তমানেও খুব একটা চাষ করা হয় না। 

আঙ্গুর পল্টি উচ্চমূল্যের হওয়ার কারণে বরাবরই সাধারণ ধরাছোঁয়ার বাইরে এটি থাকে। তবে আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ু আঙ্গুর চাষের জন্য বেশ উপযোগী। 

এখন বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন জেলায় থেকে আস্তে আস্তে আঙ্গুর বাগান গড়ে উঠছে। তাই বলা যায় সুদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আঙ্গুর চাষের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!

উপসংহার 

পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে উল্লিখিত সঠিক আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে আঙ্গুর চাষ করা গেলে ইনশাল্লাহ অবশ্যই লাভবান হবেন। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top