ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি : বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন সবজি গুলোর মধ্যে ভেণ্ডী বা ঢেঁড়স অন্যতম প্রিয় সবজি। হাইব্রিড বা সংকর জাতের ভেন্ডী গ্রীষ্মকাল ছাড়াও প্রায় সারাবছরই চাষযোগ্য।
কারণ, ভেণ্ডী চাষের প্রধান সমস্যা, ‘সাহেব রোগ’ বা মোজেইক রোগ অধিকাংশ সংকর জাতের ভেণ্ডীতেই হয় না। শুধু রান্নায় নয় কৌটোয় সংরক্ষিত খাদ্য হিসাবেও ভেণ্ডী ব্যবহার হয়।
ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি
ঢ়েঁড়সের পুষ্টিগুন
ঢ়েঁড়সে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন এ. বি ও সি এবং আয়োডিন পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢ়েঁড়সে খাদ্যগুণের পরিমাণ – প্রোটিন ১.৯ গ্রাম, শর্করা-৬.৪ গ্রাম, আঁশ ১.২ গ্রাম, ক্যালোরি ৩৫ ক্যালসিািয়ম-৬.৬ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম-৪৩ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম-১০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ-৮৮ আই. ইউ. ভিটামিন-সি-১৩ মিলিগ্রাম।
ঢ়েঁড়সের উপকারিতা
ঢ়েঁড়সে যথেষ্ট পরিমানে আয়োডিন থাকায় নিয়মিত ঢ়েঁড়স খাওয়ার ফলে আয়োডিনের অভাবজনিত গলগণ্ড রোগের সম্ভাবনা কমে যায়। মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের দৌর্বল্যের প্রতিরোধে ভেণ্ডী বেশ উপকারী। এছাড়া, ভেণ্ডী গাছের আঁশ কাগজ শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
ঢ়েঁড়স চাষ পদ্ধতিতে উপযুক্ত জলবায়ু
মূলত ঢ়েঁড়স চাষের জন্য দীর্ঘস্থায়ী উষ্ণ আবহাওয়াই অনুকূল। এইজন্য, গ্রীষ্মকালেই অধিক পরিমাণে ঢেঁড়স চাষ হয়। দীর্ঘস্থায়ী ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও তুষারপাতে ঢেঁড়স গাছ বাঁচে না। ঢেঁড়স বীজ অঙ্কুরিত হতে সর্বনিম্ন ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। গ্রীষ্ম ছাড়াও বর্ষাকালে, এমনকি বৃষ্টিবহুল অঞ্চলেও হাইব্রিড ভেণ্ডী চাষ করা যায়।
ঢ়েঁড়স চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি
প্রায় সবরকম মাটিতেই এর চাষ করা গেলেও জৈব পদার্থ যুক্ত হালকা দো-আঁশ মাটি ঢ়েঁড়স চাষের জন্য আদর্শ। ঢ়েঁড়স গাছ সামান্য অম্লত্ব সহনশীল হলেও ক্ষার বা নোনামাটিতে ভালো হয় না। ঢেঁড়স চাষের উপযুক্ত অম্লত্ব হলো ৬-৬.৮।
ফাল্গুন মাস থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত হাইব্রিড ঢ়েঁড়সের বীজ বোনা যায়।
ঢ়েঁড়স চাষে মাটি চাষ ও সার প্রয়োগ পদ্ধতি
গভীরভাবে লাঙল দিয়ে ৪-৫ চাষ দেওয়ার পর বিঘা প্রতি ৪ টন পরিমাণ গোবর সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। গভীর ভাবে লাঙল চাষের ১৫ দিন পর শেষ চাষের আগে বিঘা প্রতি ১০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫ কেজি ফসফেট ও ১০ কেজি পটাশ এবং ৩ কেজি কার্বোফিউরান মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে মই দিয়ে জমি সমান করতে হবে।
ঢ়েঁড়স চাষে বীজের হার
দেশী বীজ বিঘা প্রতি ১-২ কেজি এবং হাইব্রিড বীজ বিঘা প্রতি ৫০০-৭৫০ গ্রাম। গ্রীষ্মকালে গাছের বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় গ্রীষ্মকালে বীজের হার বেশি হয়। বর্ষাকালে অপেক্ষাকৃত কম বীজ লাগে।
ঢ়েঁড়স চাষে বীজ বপন
গ্রীষ্মকালে বীজ বপনের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ সেমি. (২ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি. (১.৫ ফুট)। বর্ষাকালে সারি থেকে সারির দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হবে। বর্ষাকালে এ দূরত্ব হবে ৭৫ সেমি. (২.৫ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি. থেকে ৬০ সেমি (১.৫-২ ফুট)। চাষ ও সার প্রয়োগের ৭ দিন পরে দূরত্ব অনুযায়ী সারিতে ১টি বা ২টি করে বীজ ১ সেমি. গভীরে বসাতে হবে।
বীজ বসানোর আগে ১২-২৪ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয় এবং তাড়াতাড়ি ও সুষমভাবে চারা বের হয়। ঢ়েঁড়স বীজ ২ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম প্রতি কেজিতে এই হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ বোনার পর হালকা সেচ দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমি খুব বেশি ভিজে না যায় বা খুব বেশি শুকিয়ে না যায় ৷
ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি তে চাপান সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা
চাপান সার প্রয়োগে মূলত নাইট্রোজেন তথা ইউরিয়া সার কিস্তিতে প্রয়োগ করা হয়। বীজ বোনার একমাস পরে বিঘা প্রতি ৫ কেজি হারে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে চারার গোড়ায় মাটি দিয়ে গোড়া বেঁধে দিতে হবে ও সেচ দিতে হবে। প্রথম চাপান সার প্রয়োগের তিন সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় চাপান হিসাবে পুনরায় ৫ কেজি করে নাইট্রোজেন ও পটাশ প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে।
ঢ়েঁড়স চাষে সেচ ও ফসল তোলার পদ্ধতি
সার প্রয়োগের সাথে মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে। প্রয়োজন মতো ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেনো পানি জমে না থাকে। সাধারনত বীজ বোনার ৫০-৬০ দিনের মাথায় ফসল তোলা শুরু হয়। প্রতি ৩/৪ দিন অস্তর ছুরি দিয়ে বোঁটা কেটে ভেণ্ডী তোলা উচিত। রাত্রের দিকে ফলের বৃদ্ধি ভালো হয় বিধায় সকালে ফসল তোলা অধিক লাভজনক হয় ৷
ঢ়েঁড়স চাষে ফলন
বিঘা প্রতি হাইব্রিড ঢ়েঁড়স গড় ফলন ২৫-৩০ কুইন্টাল বা ২৫০০-৩০০০ কেজি। হাইব্রিড ভেণ্ডীর অধিকাংশ জাতের বৈশিষ্টা হলো, গাছ লম্বা হয়ে যায়। কখনও কখনও ৮-১০ ফুট লম্বা গাছও দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে, মাটি থেকে ১-১.৫ ফুট উঁচু থেকে গাছ কেটে বিঘা প্রতি ৫ কেজি হারে নাইট্রোজেন তথা ইউরিয়া চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করে সেচ দিলে নতুন ডালপালা বেরিয়ে অধিক ফলন দেয়।
উন্নত জাত
বিজয়, বিশাল, বর্ষা, নং-৭, মাহিকো-১০, মাহিকো-১২, ইমপ্রুভড বিজয়, নাথশোভা-১১০, অমর, অজয়-২, শ্যামলী, গ্রীন বেস্ট (সাকাতা) ইত্যাদি। দেশী জাতের মধ্যে কিছু পরিমানে সাহেব রোগ বা মোজাইক রোগ সহনশীল জাত হলো পার্বণী ক্রান্তি ও সাতশিরা। তবে, গ্রীষ্মকাল ব্যাতিত বর্ষাকালের জন্য হাইব্রিড জাতের ঢ়েঁড়স চাষ করাই উচিত।
ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি তে রোগ-বালাই
সযত্ন ও পরিচ্ছন্ন চাষ করা সত্ত্বেও ঢ়েঁড়স চাষে নানা রোগ-পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে, প্রয়োজন অনুযায়ী ফসল সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক) হলুদ শিরা মোজেইক বা সাহেব রোগ:
ঢ়েঁড়স চাষের প্রধান সমস্যা হলো এই সাহেব রোগ। এ রোগের প্রধান লক্ষন হলো পাতার শিরা হলুদ ও বর্ণহীন হয়ে যাওয়া, শিরা-উপশিরাগুলি মোটা হয়ে যাওয়া এবং কখনও কখনও শিরা-মধ্যবর্তী অংশও হলুদ হয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া।
এর সাথে পাতাগুলোতে হলুদ ছাপ ছাপ দেখায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, ফল ছোটো ছোটো এবং ফ্যাকাসে রঙের ও বিকৃত আকার-আকৃতি লাভ করে। এটি একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। ভাইরাস উদ্ভিদের কোন কোন রোগ সৃষ্টি করে জেনে নিন!
সাহেব রোগের প্রতিকার:
কার্বোসালফান (০.২%) বা ইমিডাক্লোপ্রিড (০.০২%) পর্যায়ক্রমে স্প্রে করলে সাদামাছি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে, ওষুধ স্প্রে করার পর কমপক্ষে ৭ দিন ফল তোলা যাবে না। ফলন্ত গাছে তামাকপাতা সাবান জল মিশ্রণ স্প্রে করে সাদা মাছির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
খ) ঝিমিয়ে পড়া রোগ :
ছত্রাকঘটিত এই রোগের আক্রমণে গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে ও লম্বা না হয়ে বেঁটে হয়ে যায়। এর সাথে সাথে পাতা পুড়ে যায় ও গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, অবশেষে মরে যায়। অনেক সময় গাছ সতেজ থাকলেও অগ্রমুকুল এবং কচিফল শুকিয়ে যায়।
মূলত ঝিমিয়ে পড়া রোগাক্রান্ত গাছের মূল বা কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে কাটলে ভিতরে কালোকালো লম্বা দাগ দেখা যায়।
ঝিমিয়ে পড়া রোগের প্রতিকার:
ঝিমিয়ে পড়া রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায়গুলো হচ্ছে রোগাক্রান্ত গাছের মূলসহ তুলে ফেলা, গ্রীষ্মকালে গভীর চাষ ও শস্যচক্র মেনে চাষ করা।
এছাড়া, রোগের সম্ভাবনা দেখা দিলে ২.৫ গ্রাম প্রতিলিটার হিসাবে ম্যানকোজেব এবং ১ গ্রাম প্রতিলিটার হিসাবে কার্বেন্ডাজিম জলে গুলে পর্যায়ক্রমে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
(গ) পাতায় দাগ :
ঢ়েঁড়স চাষের এ রোগে পাতায় গোলগোল জলবসা দাগ দেখা যায়। দাগ ক্রমশঃ কালচে রং ধারণ করে থাকে ও পাতা গুটিয়ে যায় , ঝিমিয়ে পড়ে এবং ঝুলে পড়ে। এটি একটি ছত্রাকঘটিত রোগ।
পাতায় দাগ রোগের প্রতিকার :
এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ঝিমিয়ে পড়া রোগে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেই একই ওষুধ একই মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
ঘ) নিমাটোড :
এক প্রকার কৃমি জাতীয় পোকার দ্বারা আক্রান্ত হলে গাছের শিকড়ে গাঁট গাঁট ফোলা অংশ দেখা যায় এবং গাছ ঝিমিয়ে পড়ে। গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হয় না। সরাসরি নিমাটোড নামক আণুবীক্ষণিক এ কৃমি জাতীয় জীবটিকে মেরে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
নিমাটোড রোগের প্রতিকার :
কার্বোফিউরান জাতীয় ওষুধ সারের সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করে এই রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এছাড়া, আক্রান্ত জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করে এবং তিন বছর শস্যচক্রে ঢ়েঁড়সের চাষ করে নিমাটোডের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। জেনে নিন কৈ মাছের জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন কেন!
ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি তে পোকা
ক) চোষী পোকা :
অতি ক্ষুদ্র এক প্রকার পোকা কচি পাতার রস শোষণ করে। ফলে, পাতাগুলি ক্রমশঃ বাদামি রং ধারণ করে কুঁকড়ে যায় ৷ পাতায় আক্রমনের ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও বৃদ্ধি কমে যায়।
প্রতিকার :
ফুল আসার আগে পর্যন্ত ডাইমিথয়েট প্রতিলিটার জলে ২ মিলিলিটার হারে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
খ) মাকড় :
অতি ক্ষুদ্র হলুদ ও লাল মাকড় পাতার নিচে বাসা বাঁধে ও রস শোষণ করে গাছকে দুর্বল করে দেয়। আক্রান্ত পাতা হলুদাভ হয়ে নিচের দিকে কুঁকড়ে যায়, ফুল ও ফল ধরে না।
প্রতিকার :
আক্রান্ত গাছে ফুল আসার আগে ডাইকোফল ১.৫ মিলি/লি. জলে এবং ফলন্ত গাছে ইথিয়ন ১ মিলি/লি. জলে গুলে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
গ) ফল ছিদ্রকারী পোকা :
ছোটো ছোটো কীড়া ফল ছিদ্র করে ফলের মধ্যে বাস করে ও ফল খেয়ে নষ্ট করে।
অনেক সময় কচি ডগা ছিদ্র করে ফসলের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। এ সকল ফল বাজারে কম দামে বিক্রি হয় ফলে কৃষক লকসানের মুখে পরে যায়।
প্রতিকার :
সন্ধ্যার পর কুইনালফস ২ মিলি. প্রতিলিটার জলে গুলে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করলে এই পোকা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এছাড়া, থায়োডিকার্ব ১মিলি/লি. জলে গুলে ৭ ১০দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।