পেঁপে চাষ পদ্ধতি

পেঁপে চাষ পদ্ধতি, রোগবালাই ও কীটনাশক সহ বিস্তারিত!

পেঁপে চাষ পদ্ধতি : খাদ্য হিসেবে পেঁপে বেশ স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু ৷ তেমনি পেঁপে চাষ করে বেশ ভালো পরিমানের অর্থও উপার্জন করা সম্ভব ৷ চলুন, জেনে নেই পেঁপে চাষ পদ্ধতির বিস্তারিত –

পেঁপে চাষ করার সময়

বছরের যে কোন সময় পেঁপে বুনে চাষ করা যায় ৷ তবে, কিছু কিছু মাসে পেঁপে বুনলে বেশি পরিমানে পেঁপে গাছ বেঁচে থাকে ও ফলন বেশি হয় ৷ ইংরেজি এপ্রিল মাস হচ্ছে সেরকম একটি মাস ৷ এসময়ে পেঁপে বুনলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় ৷ এরপরে রয়েছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস ৷ 

পেঁপে চাষ পদ্ধতি

উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি পেঁপে চাষের জন্য সর্বোত্তম ৷ এরকম জমি নির্বাচন করে তাতে চারা বুননের ১৫ দিন আগেই গর্ত করে, সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করতে হবে ৷ এর ১৫ দিন পর বীজ বা চারা রোপন করে দিতে হবে ৷

চারা রোপনের পর নিয়মিত গাছে পানি দিতে হবে ও আগাছা দমন করতে হবে ৷ গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ৷ 

প্রতিটি পেঁপের চারা ১.৫ থেকে ২ মাস বয়সী হলেই রোপন করা যাবে ৷ প্রতিটি চারার দূরত্ব হবে ২ মিটার করে ৷ পেঁপে গাছের জন্য তৈরিকৃত সারির মাঝে নালা কাটতে হবে ৷ যার আকৃতি হবে ৫০ সেমি।

সাধারনত চারা রোপনের ৬-৮ মাসের ভেতরেই পেঁপে সংগ্রহ করা যায় ৷ এজন্য পেঁপে চাষ অত্যন্ত লাভজনক ৷ 

টবে পেঁপে চাষ পদ্ধতি 

টবে পেঁপে চাষ করার জন্য বামন জাতের পেঁপে গাছের চারা নির্বাচন করতে হবে ৷ টবের আকৃতি হবে কমপক্ষে ১৫ ইঞ্চি ৷ টবে মাটি ও সার দিয়ে আগেই প্রস্তুত করে রাখতে হবে ৷ সার হিসেবে কম্পোস্ট ১:২ অনুপাতে ব্যবহার করতে হবে ৷

পেঁপের বিচি বুনার সময় ২-৩ ইঞ্চি সমপরিমাণ দূরত্ব রেখে বিচি বুনতে হবে ৷ টবের গাছকে নিয়মিত পানি দিতে হবে ৷ গাছ বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে গাছে পানি দেওয়া বাড়াতে হবে ৷ টবের গাছকে দৈনিক ৬ ঘন্টা সূর্যের আলোতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে ৷ 

হাইব্রিড পেঁপে চাষ পদ্ধতি

হাইব্রিড জাতের পেঁপের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে রেড লেডি, টপ লেডি জাতের পেঁপে ৷ নিম্নে আলাদাভাবে এই দুটি হাইব্রিড জাতের পেঁপে চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ৷ 

ছাদে পেঁপে চাষ পদ্ধতি

ছাদে পেঁপে চাষ করার জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে টবে চাষ পদ্ধতি অনুযায়ী চাষ করা ৷ এ পদ্ধতিতে পেঁপে চাষে সফলতা পাওয়া যায় ও ছাদে চাষের জন্য যা পুরোপুরি উপযুক্ত ৷ 

টপ লেডি পেঁপে চাষ পদ্ধতি 

টপ লেডি অন্যতম জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতের পেঁপে ৷ টপ লেডি বীজ সংগ্রহ করে তা রোদ লাগবে এরকম জায়গা বুনে দিতে হবে ৷ ২ মাস পরে সেখান থেকে চারা নিয়ে সার দিয়ে মাটি কুপিয়ে সেখানে বুনতে হবে ৷

নিয়মিত গাছে পানি দিতে হবে ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে ৷ দুই সারির মাঝে নালা কাটতে হবে যেন পানি জমে না থাকে ।

চারা বপনের ৮-১০ মাসের ভেতরে গাছ থেকে পেঁপে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করা যাবে ৷ 

পেঁপে চাষ পদ্ধতি

রেড লেডি পেঁপে চাষ পদ্ধতি

রেড লেডি পেঁপের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস ৷

মাটি প্রস্তুত করে বীজ বপন করতে হবে ৷ দেড় থেকে দুই মাস বয়সী চারা ২ মিটার দূরে দূরে রোপন করতে হবে ৷ চারা রোপনের জন্য তৈরিকৃত গর্তে ১৫ দিন আগেই সার প্রয়োগ করে মাটি উলটপালট করে দিতে হবে ৷ দুই সারির মাঝে নালা কাটতে হবে ৷

রেড লেডি গাছের উচ্চতা হয় সর্বোচ্চ ১০ ফিট ৷ ৫ মাস বয়সী গাছে ফুল আসে আর ফল পরিপক্ক হতে ৯-১০ মাস লাগে ৷ একেকটি গাছে ৬০ থেকে ১১০ টি ফল হয় ৷

পেঁপে গাছের রোগবালাই    

পেঁপে গাছে সাধারণত রোগবালাই একটু বেশি হয় ৷ কিছু কমন রোগ আছে যা সাধারণত পেঁপে গাছে আক্রমণ করে থাকে ৷ সেই রোগগুলো হচ্ছে : 

  •  গাছ ঢলেপড়া ও কান্ড পঁচা রোগ
  •  পেঁপের পাতা কোঁকড়ানো
  •  এ্যানথ্রাকনোজ
  •  গাছের মোজাইক রোগ
  •  মিলিবাগ পোকার আক্রমন 

পেঁপে গাছ ঢলেপড়া ও  কান্ড পঁচা রোগ 

সাধারণ পেঁপে যেখানে বুনা হয় তার মাটি  ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলে পেঁপে গাছের চারা ঢলে পরে ৷ আর অতিবৃষ্টির ফলে কান্ডপঁচা রোগ হয়ে থাকে । কান্ড পঁচা রোগর উপসর্গ হচ্ছেঃ পেঁপে গাছের গোড়ার দিকে বাদামি বর্ণের পানি ও ভেজা দাগ দৃশ্যমান হয় । 

প্রতিকার

পেঁপের বীজতলার মাটি অবশ্যই শুকনা রাখতে হবে এবং ছত্রাক নাশক ২-৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে । আক্রান্ত চারা উঠিয়ে ফেলতে মাটিতে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে । প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রিডোমির এম জেড-৭২ ছত্রাক নাশক মিশিয়ে কাণ্ডে স্প্রে করতে হবে ।

>> এলাচ চাষ পদ্ধতি ও এর উপকারিতা সহ বিস্তারিত জেনে নিন।

পেঁপের মোজাইক রোগ

মোজাইক হচ্ছে ভাইরাস জনিত একটি রোগ । মোজাইক রোগের কারণে পেঁপে গাছের পাতায় হলুদ রং এর ছোপ ছোপ পরকে দাগ দেখা যায় । পাতার বোঁটা বেঁকে থাকে এবং গাছের বৃদ্ধি হওয়া কমে যেতে থাকে । সাধারণত যার্ব পোকার আক্রমণে মোজাইক রোগ বিস্তার লাভ করে ।

প্রতিকার

মোজাইক রুগে আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে । রোগ বিস্তার কারী পোকা দমন করে এ রোগের বিস্তার রোধ করা যাবে ৷ 

মিলিবাগ পোকা

আধুনিক সময়ে মিলিবাগ পোকাকে পেঁপের একটি ক্ষতিকর পোকা হিসাবে ধরা হয় । মিলিবাগ পোকার আক্রমণে গাছের পাতা ও ফর শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয় । এর ফলে আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ পরে যায় ।

প্রতিকার

মিলিবাগ পোকার আক্রমণ হলে প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা ও ফল  বা কাণ্ড মাটিতে পুতে বা আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করতে হবে । যদি পোকা বেশি ধরে তবে এডমায়ার ২০০এসএল ০.২৫ মি.লি. হারে বা সাবানের পানি ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৫-৭ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করে দিতে হবে ৷

পেঁপে গাছের কীটনাশক 

  • বর্দোমিকচার : পেঁপের উইল্টিং রোগ হলে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ১% বর্দোমিকচার বা কুপ্রাভিট ৪ গ্রাম করে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । 
  • নোভাস্টার : নোভাস্টার পোকা দমন করতে ০২ মিলি অথবা হেমিডর বা পিমিডর  বা এডমায়ার ০১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন নিয়মিত স্প্রে করতে হবে ।
  • ইমিডাক্লোরোপ্রিড : পেঁপে গাছের পাতায় হলদে মোজাইক ও পাতা কোকড়ানো রোগের বাহক পোকা (জাবপোকা) দমন করতে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার ।

পেঁপে গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি

পেঁপে গাছে সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় ৷ এজন্য পেঁপে গাছ প্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং সমপরিমাণ এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে । পেঁপের চারা রোপণের পর যখন গাছে নতুন পাতা আসবে, সেসময় গাছে ইউরিয়া ও এমওপি সার ৫০ গ্রাম করে প্রতি মাসে দিতে হবে।

>> আলু চাষ পদ্ধতি – জেনে নিন আলু কিভাবে চাষ করতে হয়?

পেঁপে চাষে খরচ

পেঁপে চাষ করতে সাধারণত তেমন খরচ হয়না ৷ সার, কীটনাশক মিলিয়ে পেঁপে গাছপ্রতি ৬০-৭০ টাকা সর্বোচ্চ খরচ হয়ে থাকে ৷ 

শেষ কথা 

পেঁপে চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে পেঁপে চাষে প্রচুর লাভবান হওয়া যায় ৷ নিয়মিত গাছের যত্ন ও সার প্রয়োগ সফল হবার গোপন সূত্র ৷ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top