পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি : মানব সভ্যতার ইতিহাসে আদিম কাল থেকেই পেঁয়াজের ব্যবহার হয়ে আসছে। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের মানুষরাই রান্নার সাথে পেঁয়াজ ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে কাঁচা, জমানো, আচার, চূর্ণ, কুচি, ভাজা এবং শুকনো করা পেঁয়াজ বহুলভাবে প্রচলিত।
পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি
ইতিহাস ও উৎস
পেঁয়াজ হচ্ছে অ্যালিয়াম গোত্রের সকল উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম হল Allium cepa. এটি একটি দিবর্ষী অথবা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ হলেও এটাকে বার্ষিক উদ্ভিদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পিঁয়াজে এক বিশেষ কেমিক্যাল রয়েছে যা আমাদের চোখে জ্বালা সৃষ্টি করে।
দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যে পেঁয়াজ একটি মৌলিক উপকরণ এবং প্রায় সব রান্নাতেই পেঁয়াজের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। পেঁয়াজ অনেক ধরনের হয়ে থাকে ঝাঁজালো, তিতা, মিষ্টি ইত্যাদি। পিঁয়াজ কে ভিনেগার অথবা সিরকাতে ডুবিয়ে আচার বানানো হয়ে থাকে।
মাটি নির্বাচন
পেঁয়াজের চাষ সব ধরনের মাটিতে করা গেলেও সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিতে চাষ করা উত্তম। মাটিতে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের আলো ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রহস্য থাকলে পেঁয়াজের ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়।
রবি মৌসুমের পেঁয়াজের চাষের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ১৫-২৫ ডিগ্রি হলে ভালো হয়। জমিতে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যকিরণ থাকতে হবে। তাহলে জমিতে রোগবালাই কম হবে। আর বর্ষাকালে পেঁয়াজ চাষের জন্য উঁচু জমি প্রয়োজন যেখানে বৃষ্টির পানি জমবে না।
পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি তে জমি তৈরি
জমিকে কমপক্ষে ৫-৬ টি চাষ দিয়ে ও ভালোভাবে মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। মই দেওয়ার জমির মাটি অবশ্যই ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। পেঁয়াজের জমিকে বেড করে করে তৈরি করে নিতে হবে।
বেডের মাঝখানে অবশ্যই চিকন করে নালা তৈরি করতে হবে। জমিতে এমনভাবে নানা তৈরি করতে হবে যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি সরে যেতে পারে।
জাত পরিচিতি
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তিক উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের জাতগুলো হলোঃ- বারি পেঁয়াজ -১ (শীতকালীন), বারি পেঁয়াজ -২ (গৃষ্মকালীন), পেঁয়াজ -৩ (গৃষ্মকালীন),বারি পেঁয়াজ -৪ (শীতকালীন), বারি পেঁয়াজ -৫ (গৃষ্মকালীন) বারি পেঁয়াজ -৬ (শীতকালীন) ইত্যাদি।
স্থানীয় জাতগুলো হলঃ- তাহেরপুরী, ফরিদপুরের ভাতি, কৈলাসনগর, ঝিঁটকা ইত্যাদি। তবে এসব জাতগুলো থেকে অধিক পরিমাণে ফলন বেশি পাওয়া যায় হাইব্রিড জাতগুলোতে।
বর্তমানে লালতীর ফেডারেশনসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি বিদেশ থেকে হাইব্রিডদের পেঁয়াজের বীজ মার্কেটিং করে আসছে। এই জাত গুলোর বীজ ভালো হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে গুলো গ্রহণযোগ্য। পেঁয়াজের ১৫টি উপকারিতা জেনে নিন!
বীজ শোধন
অন্যান্য ফসলের মধ্যে পেঁয়াজের বীজ কি অসাধারণ করে নিতে হয়। ব্যাভীস্টিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে বীজ শোধনের ক্ষেত্রে। এই ওষুধগুলো প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ গ্রাম হলেই যথেষ্ট।
উপরে উল্লেখিত ঔষধটি না থাকলে কার্বেডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে পারেন। বীজ শোধন না করে জমিতে রোপণ করলে রোগবালাই বৃদ্ধি পায়।
বীজ বপনের সময়
মূলত বাংলাদেশের রবি ও খরিপ মৌসুমে গৃষ্ম কালীন পেঁয়াজ চাষ করা হয়ে থাকে। আগাম চাষের জন্য মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।
আবার নাভি চাষ করতে হলে মধ্য জুন পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপন করা যাবে। এরপর নাভি চাষের জন্য জুলাই থেকে আগস্ট মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা প্রয়োজন। তারপর ৪০/৪৫ দিনের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
আধুনিক বোর ধান চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!
সার ব্যবস্থাপনা
মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এর পাশাপাশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক সারের মিশ্রণের জমির ফলন অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। এতে পেঁয়াজ বেশ বড় ও ভারী হয় যা অনেক দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
অবশ্য জমিতে সারের মাত্রা নির্ভর করে মাটির অবস্থা ভেদে। জমিতে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সারের উপস্থিতি থাকে তাহলে সারের পরিমাণ কম হলেও হবে।
পেঁয়াজ চাষে সারের তালিকা
সারের নাম | সারের পরিমাণ/ হেক্টর | |
সেচ সহ (কেজি) | সেচ ছাড়া (কেজি) | |
ইউরিয়া | ১৮০-২২০ | ১৪০-১৮০ |
টিএসপি | ১৪০-১৮০ | ১৪০-১৮০ |
এমপি | ৪০-৫০ | ৩০-৪০ |
জিপসাম | ১১০-১২০ | ৭০-৯০ |
গোবর/ কম্পোস্ট (টন) | ৭-১০ | ৭-১০ |
সেচ ব্যবস্থাপনা
পেঁয়াজের চারা রোপণের পরপরই একটি চাষ অবশ্যই দিতে হয়। অতঃপর জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিতে হবেই। বর্ষা মৌসুমে যাতে জমিতে বৃষ্টির পানি জমতে না পারে সেজন্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আগাছা দমন
জমিকে সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সেচের পর অবশ্যই জমির মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে। জমিতে পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের জন্য ফুলের কুঁড়ি দেখামাত্র অবশ্যই ভেঙ্গে দিতে হবে।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
পেঁয়াজ চাষে যেসব রোগ লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো পেঁয়াজে পারপেল ব্লুচ, গোড়া পচা রোগ ইত্যাদি। এই রোগগুলো দমন করতে হলে অনুমোদিত কীটনাশক রিডোমিল গোল্ড ও ডায়থেন এম ৪৫ ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ওষুধ মিশিয়ে ২/৩ বার জমিতে স্প্রে করতে হবে। পোকামাকড়ের মধ্যে থ্রীপস ও জাব পোকা সবচেয়ে মারাত্মক। এই পোকাগুলো দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
পেঁয়াজের গাছ পরিপক্ক হলে গাছের টিস্যু নরম হয়ে যায়। হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ গুলো চাষের ক্ষেত্রে বয়স ৭০-৮০ এই না হলে সংগ্রহ করা যায় এবং নাবও জাতের পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে বয়স ৯৫-১১০ দিন হলে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ফসল বাছাই ও গ্রেটিং করার পর বাঁশের মাচা, ঘরের সেটিং, প্লাস্টিক অথবা ঘরের মেঝেতে যেখানে বায়ু চলাচল করে সেখানে পের সংরক্ষন করতে হবে। গৃষ্ম কালীন পেঁয়াজের আদ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে বলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না।
ফলন
পেঁয়াজ চাষে পরিচর্যা খুব ভালোভাবে করা হলে জাত ভেদে হেক্টর প্রতি ১৩-২০ টন পাওয়া সম্ভব। সরাসরি বীজ বপন করে চাষ না করে পেঁয়াজের চারা তৈরি করে চাষ করলে ২০-২৫ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করা যায়।যে পদ্ধতিতে পুইশাক চাষ করলে অধিক লাভবান হবেন!
উপসংহার
উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ও উপযুক্ত একটি ধারণা লাভ করতে পেরেছি। তাই আসুন উল্লেখিত সঠিক নিয়ম ফলো করে পেঁয়াজ চাষ করি, সাথে অধিক ফসল গড়ে তুলি। কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়ার উপকারিতা জেনে নিন!