বোর ধান চাষ পদ্ধতি

আধুনিক বোর ধান চাষ করার সঠিক ও কার্যকারি পদ্ধতি জেনে নিন!

বোর ধান চাষ পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধান হল আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য। সেইসাথে ধান আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সঠিকভাবে ধান চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে চাষ করা গেলে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যায়। 

বোর ধান চাষ পদ্ধতি

ধান 

ধান হচ্ছে ওরিজা স্যাটিভা ও ওরিজা প্ল্যাবেররিমা নামো ঘার জাতের বীজ। ধান গাছের যুক্ত থাকে এবং ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ধানের একটি গোলাকার সংযুক্ত কান্ড আছে এবং পাতাগুলো লম্বা ও সূক্ষ্ম । এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ করা হয়ে থাকে।

যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ করা হয়ে থাকে সেগুলো হলো ভারত, চীন, জাপান ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ইত্যাদি। বিশ্বে ধান উৎপাদনের শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। তবে সবচেয়ে ভালো মান সম্পন্ন ধান উৎপাদিত হয় ভারতে। 

বাংলাদেশ ধানের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। বর্তমানের আধুনিক জাতের অনেক ধান বেরিয়েছে যেগুলোর ফলনও অত্যাধিক। বাংলাদেশের ৩ মৌসুমে ধান চাষ করা হয়ে থাকে, আমন, আউশ ও বোরো মৌসুম। 

মাটি নির্বাচন  

পলি, দোআঁশ ও নুড়ি বিভিন্ন মাটিতে বোর ধান জন্মায়। তবে অম্লীয় ও ক্ষারীয় মাটিতেও বোর ধান চাষ করা যায়। তাছাড়া গভীর উর্বর এ বেলে বা দোআঁশ মাটি যা সহজেই কাঁদায় ঢেলে দেওয়া যায় ও পরবর্তীতে মাটির শুকিয়ে গেলে ফাটল সৃষ্টি হয়, এই ধরনের মাঠে বোর ধান চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। 

বোর ধান চাষ পদ্ধতি তে জমি তৈরি 

বোর ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় হতে হবে। জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে নরম করতে হবে। জমিতে ৪ থেকে ৫ টি চাষ ও মই দিয়ে সমান করতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রথম চাষ দেওয়ার পরে অন্তত সাতদিন জমিতে পানি আটকে রাখতে হবে যাতে জমিতে এমাইনো নাইট্রোজেন বৃদ্ধি পায়। 

চারা রোপণ 

বোর ধানের বীজ থেকে ধানের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। অতএব বীজ নির্বাচন ফলন বেশি পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেরা মানসম্পন্ন বীজ বাছাই করতে হবে। 

  • বীর সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক ও বিকশিত হতে হবে। 
  • ধানের বীজ পরিষ্কার হবে
  • বার্ধক্যের কোন লক্ষণ থাকবেনা 
  • অঙ্কুরোদগমের উচ্চ ক্ষমতা থাকবে 

বীজতলা থেকে ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানে তুলে এনে সারি করে রোপণ করা যেতে পারে। শাড়ি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সেন্টিমিটার ও চারা থেকে চারা দূরত্ব ১৫-২০ সেন্টিমিটার। আবার জমির উর্বরতা এবং জাতের কুশি ছড়ানোর ওপর নির্ভর করে দূরত্ব বাড়তে পারে আবার কমতেও পারে। 

প্রতিটি গোছায় ২ থেকে ৩ টি সুস্থ সবল চারা ২.৫ বা ৩.৫ সেন্টিমিটার গভীরে রোপন করতে হয়। কম গভীরে চারা রোপন করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয়, সর্বোপরি ফলনও অধিক বৃদ্ধি পায়। জমিতে ১.২৫ সেন্টিমিটার মাথা চেপে পানি রাখা ভালো। 

বর্তমান সময়ে ব্রি ধান ৮৭ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে, অধিক পরিমাণে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। কারণ এ জাতের ধান গুলির বাজারমূল্য খুবই বেশি। এ জাতের ধান গুলি আবার বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।  সফল হওয়ার জন্য জেনে নিন সঠিক মাশরুম চাষ পদ্ধতি!

সার ব্যবস্থাপনা 

বোর ধান চাষ পদ্ধতি তে সার ব্যবস্থাপনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অধিক ফলন পেতে হলে জমিতে জৈব সার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে কোন অবস্থাতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না।

বিঘা প্রতি বা ৩৩ শতকে সারের পরিমাণ হচ্ছে ইউরিয়া ৩৫ কেজি, টিএসপি বা ডিএপি ১২ কেজি, এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম বা গন্ধক ১৫ কেজি, দস্তা (মনোহাইড্রে) ১.৫ কেজি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে ধানের জাত ভেদে সারের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে আবার বাড়তেও পারে। 

এই রাসায়নিক সার গুলোর পাশাপাশি অবশ্যই জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। বোর ধানের ক্ষেত প্রস্তুত করার সময় শেষ চাষের সময় টিএসপি বা ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা সারের পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।  আর পরবর্তীতে ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। 

ইউরিয়া সারের ১ম কিস্তি হচ্ছে চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর। তারপর ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর। আর শেষ কিস্তি হচ্ছে কাইচথোর আসার ৫-৭ দিন আগে। আগেই বলেছি জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। 

বোর ধান চাষ পদ্ধতি তে সেচ ব্যবস্থাপনা 

ধান গাছ কোন জলজ উদ্ভিদ না, তবে এরা পানি পছন্দ করে। বোর ধানের জমিতে অতিরিক্ত পানি দেওয়া উচিত নয়। এতে ধানের বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা যায়। চারা রোপণের সময় জমিতে পানি ছিপছিপে থাকবে। পরবর্তী ১০ পরে জমিতে পানি দেড় থেকে দুই ইঞ্চি হবে। 

অতঃপর ১১ দিন থেকে থোড় আশা পর্যন্ত জমিতে পানি দেড় ইঞ্চি রাখতে হবে। আবার থোড় আসলে জমিতে পানির পরিমাণ ২ ইঞ্চি করতে হবে। পরবর্তীতে ধান কাটা ১০ থেকে ১২ দিন আগে জমি থেকে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 

বোর ধানের রোগ ব্যবস্থাপনা 

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ভালো ফলনের জন্য সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। কারণ বোর ধানের জমিতে অতিরিক্ত আগাছা থাকলে রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে। বোর ধান ক্ষেতে যেসব পোকা আক্রমণ করে মাজরা, পোকা গলমাছি, পামরি পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা, লেদা পোকা, ঘাসফড়িং, লম্বাশুড় উরচুঙ্গা, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামী গাছ ফড়িং ইত্যাদি। 

বোর ধানের রোগ গুলো হল টুংরো, ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া, উফরা, ব্লাস্ট, খোলপোড়া, বাকানি, বাদামি দাগ, খোল পচা, লক্ষীর গু পাতা লালচে রেখা ইত্যাদি। উপরে উল্লিখিত পোকা এবং রোগগুলো থেকে ধানকে রক্ষা করতে কৃষি কর্মকর্তাদের সঠিক পরামর্শ নিতে হবে। কৃষি কর্মকর্তাদের সঠিক পরামর্শ অনুযায়ী অনুমোদিত বালাইনাশক জমিতে ব্যবহার  করতে হবে। 

বোর ধান চাষের ক্ষেত্রে পোকামাকড় ও রোগ থেকে ধান কে রক্ষা করতে হলে নিচে দেওয়া রোগ দমনের তালিকাটি ফলো করতে পারেন। লাল শাকের সঠিক চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!

ফসল কাটা 

কৃষি বিজ্ঞানীদের সঠিক পরামর্শ হচ্ছে শতকরা ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে বোর  ধান কেটে ফেলতে হবে। ধান খেতে অতিরিক্ত পেকে না যায় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আর এখন বর্তমানে অত্যাধুনিক ধান কাটার মেশিন গুলো বেরিয়েছে। এই মেশিন গুলোর মাধ্যমে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আপনি আপনার ধান ঘরে তুলতে পারেন। 

বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ করা হয়ে থাকে। বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রে এখন একটি নতুন প্রযুক্তি হচ্ছে উন্নত হাইব্রিড ধান চাষ করা যেখানে ফলন ৩০% বেশি পাওয়া যায়। উপরে উল্লেখিত চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত বোরো চাষ করা সম্ভব। বোর মৌসুমেও হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি অনুসরন করা হয়

বোর ধান চাষ পদ্ধতি তে সার ব্যবস্থাপনা তালিকা

সারের নাম সমূহপরিমাণ(কেজি/হেক্টর প্রতি)প্রয়োগের সঠিক সময়
ইউরিয়া     ২৭০ কেজি১/৪ অংশ শেষ বার জমি চাষের সময় দিতে হবে । ১/৪ অংশ চারা রোপণের ১৫-২৫  দিন পর ১/৪ অংশ, ৩৫/৪০ দিন পরও  অবশিষ্ট ১/৪ কাইচথোড় আসার সময় দিতে হবে ।
টিএসপি অথবা  ডিএপি১৩০ কেজি   শেষ চাষের সময় দিতে হবে  ।
এমপি১২০ কেজি    ২/৩ অংশ শেষ বার জমি চাষের সময় দিতে হবে ও১/৩ ,অংশ দ্বিতীয় উপরি প্রয়োগের সময় ।
জিপসাম৭০ কেজি   শেষ বার জমি চাষের সময় দিতে হবে ।
দস্তা বা জিংক সালফেট১০ কেজি   শেষ বার জমি চাষের সময় দিতে হবে  ।
বোর ধান চাষ পদ্ধতি

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন 

মাজরা পোকামরা ডিগ ও মরা শিষ দেখা দিতে পারে। বাসুডিন ১০ জি. বিঘায় ২.৫ কেজি হারে কাইচথোড় আসা অবস্থায়  প্রয়োগ করতে হবে।
গান্ধি পোকাকচি ধানের দুধ চুষে খেয়ে পেলে, ফলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে।।ডায়াজিনন ৬০ ইসি. ১.৫ মিলি বা লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে, অথবা কার্বোসালফার অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। 
পাতা পোড়াপাতার কিনারা পুঁড়ে যায় ক্ষেতের পানি ৮-১০ দিনের জন্য শুকিয়ে ফেলতে হবে ও  বিঘা প্রতি ৪ কেজি পটাশ সার ছিপছিপে পানিতে প্রয়োগ করা।
খোল পচা রোগপাতার খোল পচে যেতে পারেটিলট্ ২৫০ ইসি. ১ মিলি বা লিটার পানি হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
টুংরোগাছের পাতা হলদে বা কমলা রঙ ধারণ করে থাকে ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসিঃ ১.৫ মিলি বা লিটার পানি হারে দেওয়া যেতে পারে। 
ব্লাস্টপাতায় চোখের আকৃতির মতো দাগ হতে পারে।ট্রপার বিঘায় ৫০ গ্রাম ট্রপার ১ গ্রাম বা লিটার পানি হারে দিতে পারেন 
বোর ধান চাষ পদ্ধতি

ফাতেমা ধান

ফাতেমা জাতের ধান অন্যান্য যে কোন জাতের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জাতের ধান গুলি অধিক ফলন দিতে পারে। বাগেরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নারী ফাতেমা বেগমের জমিতে এই ধানের চাষ করা হওয়ায়। এটি ফাতেমা ধান হিসেবে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছে। এ জাতের ধান চাষ করে আপনিও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। 

আমন ধান চাষ পদ্ধতি

আমন ধান মূলত আমন চাষ উপযোগী মৌসুমে করা হয়ে থাকে। খরা প্রবণ এলাকায়ও আমন ধান চাষ করা যায়। আমন ধান চাষের ক্ষেত্রে বর্তমানে কিছু নিত্যনতুন ধানের জাত আবিষ্কৃত হয়েছে। 

যেমনঃ বিআর-৮, বিআর-৫, বিআর-৮, বিআর-৩৮, বিআর-২৩, বিআর-২২, বিআর-২৫, ব্রি ধান-৩০, ব্রি ধান-৩২, ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৩৩, ব্রি ধান-৩৭, ব্রি ধান-৩৯, ব্রি ধান-১০, নাইজারশাইল, বিনাধান-৪ ইত্যাদি। 

উপকূলীয় অঞ্চলে চাষ করার জন্য  সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উপযোগী উফশি জাতের (ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৬২, ব্রি ধান-৪৪, ব্রি ধান-৫৪, ব্রি ধান-৫৩, ব্রি ধান-৫৭, ব্রি ধান-৫৬, ব্রি ধান- ৪২) চাষ করা যাবে।

আমন ধান চাষের ক্ষেত্রে ভালো ফলন পেতে হলে সুষম সার ব্যবহার করা আবশ্যক। আর জমির উর্বরতা অনুসারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বোর ধান চাষ পদ্ধতির সঠিক ও উপযুক্ত একটি ধারণা লাভ করতে পেরেছি। উপরে উল্লিখিত সঠিক নিয়ম ফলো করে যদি বোর ধান চাষ করা যায়, তাহলে ইনশাআল্লাহ কৃষক অধিক লাভবান হবেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top