হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি

হাইব্রিড ধান চাষ করার সঠিক পদ্ধতি জেনে নিন!

হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি : বাংলাদেশ কম আয়তনের একটি ছোট দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুন চাষযোগ্য জমি দিন দিন কমছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে অল্প জমিতে অধিক ফলন দরকার। তাই হাইব্রিড ধান চাষের বিকল্প নেই। উফশী জাতের তুলনায়  হাইব্রিড ধান চাষে ৩০-৪০% ফলন বৃদ্ধি হয়। তাই হাইব্রিড ধান চাষাবাদ সময়ের দাবি।

মূলত হাইব্রিড ধান উৎপাদন পদ্ধতি উফশী ধানচাষ পদ্ধতির মতো হলেও হাইব্রিড ধানচাষের ক্ষেত্রে বীজতলার জন্য বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। হাইব্রিড ধান চাষের উল্লেখযোগ্য দিক হলো হাইব্রিড ধানের জন্য প্রতি হেক্টরে মাত্র ২০ কেজি বীজ ব্যবহার করা হয়।

হাইব্রিড ধান চাষ পদ্ধতি

হাইব্রিড ধান চাষে বীজের পরিমান

বীজতলার জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। ৪০০ বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি বা প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৫০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে।

প্রতি গুছিতে মাত্র একটি বা দুটি চারা রোপণ করতে হবে। প্রত্যেক মৌসুমের জন্য নতুন হাইব্রিড বীজের প্রয়োজন হয়।

হাইব্রিড ধানের জাত :  এসএল ৮এইচ, ব্রি-হাইব্রিড ধান ১,২,৩,হিরা,তেজ,এসিআই-২, সাথী, লাল তীর, মধুমতি, আলোড়ন, জাগরণ, জাগরণ-৩, রূপসী বাংলা-১, রূপালী, সচ্ছল ইত্যাদি।

বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন 

হাইব্রিড জাতের ধান চাষ পদ্ধতিতে বীজ তলা তৈরির জন্য উফশী ধানের বীজতলা তৈরি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। পানিতে ডুবে না এমন উঁচু জায়গা ও গাছের ছায়া পড়ে না এরূপ জায়গা বেছে নিতে হবে। অতঃপর প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে অন্তত ৭-১০ দিন জমিতে পানি আটকে রাখা দরকার।

এরপর জমি থকথকে কাদাময় করার জন্য পুনরায় চাষ ও মই দিতে হবে। বীজতলা তৈরিতে প্রতিটি বীজতলা ১.২৫ মিটার চওড়া ও জমির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী লম্বা করতে হবে। বীজ তলার জন্য ০.৫ মিটার নালা রাখতে হবে। ফাঁকা রাখা ০.৫ মিটার জায়গা থেকে ১০ সে.মি. গভীর করে মাটি তুলে দুধারে দিতে হবে।

এতে দুই বীজতলার মাঝের নালা দিয়ে সেচ বা পানি নিষ্কাশন ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার পরিচর্যা করাও সহজ হবে। ১৫ নভেম্বর হতে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে হাইব্রিড ধানের বীজ বপন করতে হবে। পুষ্ট ও পরিষ্কার বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবিয়ে রেখে তিনদিন বস্তাবন্দি অবস্থায় জাগ দিয়ে অঙ্কুরিত করে নিতে হবে। এরকম অঙ্কুরিত বীজ প্রতি বর্গমিটারে ৫০ গ্রাম হিসেবে সমানভাবে বপন করতে হবে।

হেক্টর প্রতি মাত্র ১৫-২০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের ৩-৪ দিন পর থেকে চারা গজানো পর্যন্ত পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে রাখতে হবে।

বীজতলা তৈরিতে সার প্রয়োগ

বীজতলা তৈরির সময় প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে গোবর সার দিতে হবে। তাছাড়াও চারা সুস্থ ও সবল রাখতে জমি তৈরির সময় প্রতি বর্গমিটারে ৪ গ্রাম টিএসপি, ৭ গ্রাম এমপি এবং বীজ বোনার ১০ দিন পরে ৭ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

জমি তৈরি

উর্বর জমি, পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ও সেচের সুবিধা রয়েছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। চারা রোপণের জন্য মাটি কাদাময় করে নিতে হবে। এজন্য উত্তমরূপে চাষ ও মই দিয়ে নিতে হবে। শেষ চাষ ও মই দেয়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন জমিটা যথেষ্ট সমতল হয় এবং অনুমোদিত হারে সার ও প্রয়োগ করতে হবে।

চারা রোপন

রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা আবশ্যক। গোছা প্রতি ১ বা ২টি করে সুস্থ ও সবল চারা রোপণ করতে হবে। ৩০-৩৫ দিনের চারা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে রোপণ করতে হবে। সারিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি)। রোপণের ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে মরে যাওয়া চারার স্থলে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করতে হবে।

হাইব্রিড ধানের চাষাবাদে অনুমোদিত সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি

যদি কোনো কৃষক তাঁর জমিতে টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ২৭০ কেজির স্থলে ২১০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করবেন এবং তা তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা আবশ্যক। সার সমভাবে ছিটানোর পর হাতড়িয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগকালে জমিতে অতিরিক্ত পানি থাকলে তা বের করে দিতে হবে এবং সার প্রয়োগের ২-৩ দিন পর জমিতে পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে।

হাইব্রিড ধানের আগাছা দমন ও পানি ব্যবস্থাপনা 

আগাছা পরিষ্কার করে নিয়ে অতঃপর সার প্রয়োগ করাতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর তা মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। হাত দিয়ে বা উইডার দিয়ে অথবা আগাছানাশক প্রয়োগে আগাছা দমন করা যেতে পারে। চারা রোপণের পর থেকে জমিতে ৫-৭ সেন্টিমিটার (২-৩ ইঞ্চি) পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ধানগাছ যখন কাইচথোড় আসা শুরু করে তখন পানির পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো উচিত। কেননা এ অবস্থায় খরায় পড়লে ধানে চিটার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ফসল কর্তন 

ধানের ছড়ায় শতকরা ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ধান কাটতে হবে। যত্ন সহকারে আবাদ করলে বিঘাপ্রতি ৩০-৪০ মন ধানের ফলন পাওয়া যায়।

ইউরিয়া সারের পরিমান ও প্রয়োগ

মোট ইউরিয়া ২৭০ কেজি যার ১/৪ অংশ শেষ চাষের সময়। ১/৪ অংশ চারা রোপণের ১৫-২০  দিন পর, ১/৪ অংশ ৩৫/৪০ দিন পর এবং অবশিষ্ট ১/৪ কাইচথোড় আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে।

টিএসপি বা ডিএপিঃ হাইব্রিড ধান চাষে টিএসপি বা ডিএপি সারের প্রয়োজন হয় ১৩০ কেজি এবং শেষ চাষের সময়।

এমপিঃ হাইব্রিড ধান চাষে এমপি সারের প্রয়োজন হয় ১২০ কেজি। মোট সারের ২/৩ অংশ শেষ চাষের সময় এবং ১/৩ অংশ দ্বিতীয় উপরিপ্রয়োগের সময় প্রয়োগ করতে হয়।

জিপসামঃ হাইব্রিড ধান চাষে ৭০ কেজি জিপসাম শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়।

দস্তা/জিংক সালফেটঃ দস্তা সারের প্রয়োজন হয়  ১০ কেজি এবং শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন

মাজরা পোকাঃ এ পোকার আক্রমনে মরা ডিগ ও মরা শিষ দেখা যায়। এ পোকার আক্রমন প্রতিরোধ করতে বাসুডিন ১০ জি. বিঘায় ২.৫ কেজি হারে কাইচথোড় আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে।

গান্ধি পোকাঃ এ পোকার আক্রমনে ধানে চিটার হার বেড়ে যায়। কেননা কচি ধানের দুধ চুষে খায়,ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে ডায়াজিনন ৬০ ইসি. ১.৫ মিলি/ লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে, অথবা কার্বোসালফার অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

পাতা পোড়া (বিএলবি): এ রোগের আক্রমনে পাতার কিনারা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়। প্রতিকার হিসেবে ক্ষেতের পানি ৭-১০ দিনের জন্য শুকিয়ে ফেলা এবং বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার ছিপছিপে পানিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

খোল পচা রোগঃ এ রোগে পাতার খোল পচে যায়। এ রোগের প্রতিকার হিসেবে টিলট্ ২৫০ ইসি. ১ মিলি/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে।

টুংরোঃ ধান গাছের টুংরো রোগে গাছের পাতা হলদে/ কমলা রঙ ধারণ করে। ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসিঃ ১.৫ মিলি/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে।

ব্লাস্টঃ ধান গাছের ব্লাস্ট রোগে পাতায় চোখের আকৃতির মতো দাগ সৃষ্টি হয়। বিঘায় ৫০ গ্রাম ট্রপার ১ গ্রাম/লিটার পানি হারে প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সকল তথ্য জানুন!

ফসল সংরক্ষণ 

অন্যান্য জাতের মতোই ধান মাড়াই-ঝাড়াই করে রোদে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।

সতর্কতা 

হাইব্রিড ধানের বীজ থেকে উৎপাদিত ধান পুনরায় বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এতে ফলন আগের মতো পাওয়া যাবে না। আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য হাইব্রিড ধানের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য হাইব্রিড ধান চাষের বিকল্প নেই। তাই চাষীদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ও সহযোগিতা করতে হবে। করলা চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top