চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি

চুই ঝাল চাষ কিভাবে করবেন? চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি একনজরে জেনে নিন!

চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি : চুই ঝাল হচ্ছে বাংলাদেশের একটি অপ্রচলিত মসলা জাতীয় ফসল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশেষ করে বাগেরহাট, খুলনা সাতক্ষীরা, যশোর, পিরোজপুর, বরিশাল, ফরিদপুর এসব জেলাতে এই মসলাটি বেশি চাষ করা হয়ে থাকে। 

চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি

ইতিহাস ও উৎস 

চুই ঝালের বৈজ্ঞানিক নাম হল Piper  chaba. এটি একটি পিপারাসী পরিবারের সম্পূরক লতা জাতীয় উদ্ভিদ। মূলত পান এবং চুই ঝাল একই পরিবারের সদস্যভুক্ত। চুই ঝাল গাছ দেখতে হুবহু পানের লতার মতোই হয়। 

পাতা কিছুটা লম্বা ও পূরণ হয়ে থাকে। এই গাছের কান্ড বা লতা কেটে ছোট ছোট টুকরা করে মাছ-মাংস রান্নায় বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রান্নার পরে এই টুকরো গুলো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে। 

চুই ঝালের নিজস্ব স্বাদ ও ঘ্রাণ রয়েছে। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি স্থানীয় প্রজাতি। বাংলাদেশ ছাড়াও যেসব দেশে এই চুই ঝাল জন্মে সেগুলো হলো শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া  ইত্যাদি। 

এটি একটি জাতীয় অর্থকারী ফসল। আন্তর্জাতিক বাজারে এ ফসলের বিপুল পরিমাণ চাহিদা রয়েছে। কাফলা, কাঁঠাল শিমুল ইত্যাদি গাছে বেয়ে ওঠা চুইঝাল সবচেয়ে ভালো মানের হয়ে থাকে। 

জমি ও মাটি

পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও ছায়াময় উঁচু জমিতে চুই ঝাল সাধারণত চাষ করা যায়। দোআঁশ এবং বেলে দোআঁশ মাটি এটি চাষ করার জন্য সবচেয়ে উত্তম। বৃক্ষবাগান বা ফুল বাগানের মাটি চুই ঝাল চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

রোপনের সময় 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) এবং আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাস এই দুইবার চুইঝালের লতা জমিতে রোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

উপযুক্ত স্থান 

ছায়া অথবা আধো ছায়া জায়গাতে চুই ঝাল খুব ভালো হয়। সাধারণত বসত বাড়ির আঙ্গিনায় এধরনের স্থানে এটি চাষ করা যায়। অবশ্য চুই ঝাল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। 

তাই নিচু জমিতে চুই ঝাল গাছ লাগানো উচিত নয়। বড় কোন গাছের পাশে লাগালে বাউনি হিসেবে ওই গাছটি ব্যবহার করা যাবে। ১ শতক জায়গায় ১০ টি গাছ লাগানো যায়। 

জমি ও গর্ত তৈরি 

চুই ঝাল গাছ লাগানোর জায়গা ঠিক করার পর সেখানে সবদিকে একহাত মাকে গর্ত তৈরি করা প্রয়োজন। গাছ রোপণের এক সপ্তাহ আগে গর্তের ভিতর সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শেষ করতে হবে। 

চারা তৈরি 

বীজ, ডাল, শিকড় থেকে চুই ঝাল গাছের নতুন চারা তৈরি করা যায়। কাটিং পদ্ধতির মাধ্যমে কান্ড বা শাখা থেকে ৫০-৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা করে কেটে সরাসরি মাটিতে রোপণ করা যেতে পারে। 

আবার ফল পাকলে তার উপরের নরম আবরণ ফেলে দিয়ে, তারপর রোদে শুকিয়ে বীজ রেখে দিলে তা অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। পরবর্তী এই বীজ দিয়ে নতুন চারা তৈরি করা যায়। 

এছাড়া পলিব্যাগেও বীজ থেকে বা লতা কাটিং থেকে চারা তৈরি করা সম্ভব। সাধারণত কৃষকরা নিজেদের গাছ থেকে কাটিং তৈরি করে জমিতে রোপণ করে। যদি চারা কিনতে হয় তাহলে প্রতিটি চারার দাম ১৫/২৫ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। 

কাটিং শোধন 

চুই ঝাল গাছের কাটিং চারা রোপণের আগে অবশ্যই শোধন করে নিতে হবে। কাটিং শোধন করার নিয়ম হচ্ছে ১ লিটার পানিতে ২/৩ গ্রাম প্রোভাক্স/নোইন/অটোস্টিন মিশিয়ে কাটিং ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। 

তারপর ৩০ মিনিট পরে কাটিং উঠিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।  কাটিং যদি সঠিকভাবে শোধন করে জমিতে রোপণ করা যায় তাহলে পরবর্তীতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হবে। 

রোপন 

গর্ত তৈরি করার পর উপযুক্ত সার ব্যবস্থাপনার এক সপ্তাহ পর চুই লতা বা শেকড়ের কাটিং সরাসরি মাটিতে পুঁতে দিলে সেখান থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। তবে কাটিং রোপন করার সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তিনটি গিট থাকে।

সেই ৩ টি গিটের মধ্যে দুটি গিট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এছাড়াও পলিব্যাগের বীজ থেকে কাটিং করতে সরাসরি রোপন করা যায়। গর্তে জৈব সার দিলে গাছের বৃদ্ধি অধিক পরিমাণে হয়। চারা রোপণের ৮-১০ মাস বয়সের হলে লতা বা ডাল খাওয়ার উপযোগী হয়। 

বাউনি দেওয়া

মূলত চুই ঝাল গাছ যে সকল গাছে বাউনি হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে সেগুলো হলো শিরিষ, মেঘগিনি, দেবদারু, নিম, নারিকেল, সুপারি, আম, কাঠাল, জাম ইত্যাদি। আরে এসব গাছকে বাউনি হিসেবে ব্যবহার করলে ঝড় থেকে চুই ঝাল গাছ রক্ষা পায়। 

তবে চুই ঝাল গাছ আম ও জিকা/কচা গাছে তুলে দিলে ভালো ফলন দেয়। এর ফলে মাটিতে চুই গাছের ঝোঁপ তৈরি হয় যাকে বলা হয়  আইটে চুই। সঠিক ধনিয়া চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!

সার ব্যবস্থাপনা 

চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি তে সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অত্যাবশ্যকীয়। মূলত চারা লাগানোর এক সপ্তাহ আগে গর্তের মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে গাছের গোড়ায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। 

বর্ষার শেষে ২৫-৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রতিটি গাছের গোড়ায় দিতে হবে। সার দেওয়ার পূর্বে গাছের গোড়া হালকা ভাবে কুপিয়ে সেচ প্রদান করতে হবে। গাছের গোড়ায় সুষম সার প্রয়োগ করলে ফলন অনেকগুন বৃদ্ধি পায়। 

চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি তে সেচ প্রদান 

বলতো চুই ঝাল গাছে কোন প্রকার সেচ প্রদান করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে খরার মৌসুমে অর্থাৎ চৈত্র ও বৈশাখ মাসে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিলে গাছের জন্য ভালো হবে। 

পরিচর্যা 

চুই ঝাল গাছ চাষ করার ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা হচ্ছে প্রতিবছর বর্ষার আগে প্রতিটি গাছের গোড়ার মাটি তুললে উঁচু করে দিতে হবে। 

ফলন 

বয়সভেদে চুই ঝালের ফলনও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ৩/৪ বছরের বয়সে একটি গাছ থেকে ১.৫-২.০ কেজি চুই ঝাল পাওয়া সম্ভব।  তবে ৮/১০ বছরের একটি গাছ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত সুইজাল পাওয়া সম্ভব। 

বাজার ব্যবস্থাপনা 

চুই ঝাল গাছ কাটার পর এটি খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। কাঁচা অবস্থায় এর দাম ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু শুকিয়ে গেলে বাজারদর কমে যায়। এজন্য চুই ঝাল গাছ কেটে সবসময় পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। 

ভেজা কাপড় অথবা চড় দিয়ে পেচিয়ে রাখা যেতে পারে। আর কিছুক্ষণ পরপর পানি ছিটাতে হবে। কাটারি দিয়ে ধার টুকরো টুকরো করে কেটে ওজনে চুইঝাল হিসেবে বিক্রি করা হয়। সঠিক পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!

পরিশেষে 

অভিযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় বাংলাদেশের মত আয়তনের ছোট হিসেবে চুই ঝাল খুবই উপযোগী। এতে জমির পরিমাণ খুব অল্প হলেই চলে। তাই আমাদের উচিত সঠিকভাবে চুই ঝাল চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষাবাদ করা। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top