জানাজার নামাজের নিয়ম

জানাজার নামাজের সঠিক নিয়ম ও দোয়া সহ বিস্তারিত!

জানাজার নামাজের নিয়ম : ইসলামে জানাজার নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি।  কাফন-দাফন, মৃতের জানাজা, ইত্যাদি জীবিত মুসলমানদের ওপর মৃতদের অধিকার। কোনো মুসলিম মারা গেলে তার জানাজার নামাজ আদায় করা ফরজে কিফায়া।

তবে অনেক মুসলিম জানাজার নামাজের নিয়ম সম্পর্কে জানেন না। কিছুসংখ্যক মুসলিম এই দায়িত্ব পালন করলে অন্যরা দায়িত্বমুক্ত হবে। তবে এলাকার সব লোক এবং আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব হচ্ছে মৃতের জানাজায় অংশগ্রহণ করা এবং তার স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়া।

জানাজার নামাজের নিয়ম

জানাজা আদায়ের সওয়াব

হাদিসের বিখ্যাত মৌলিক ছয়টি গ্রন্থসহ অন্যান্য হাদিসের গ্রন্থগুলোতে রয়েছে যে- প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করল, সে এক ‘কিরাত’ পরিমাণ নেকি লাভ করল আর যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে এবং তার দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করল, সে দুই ‘কিরাত’ পরিমাণ সওয়াব লাভ করল।”

একজন সাহাবি প্রশ্ন করল, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ! দুই কিরাত মানে কী?’ প্রিয়নবী (সা.) বললেন, ‘দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কিরাত হল ওহুদ পাহাড়ের সমান।’ (ইবনে কাছির)

হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে- প্রিয়নবী (সা.) যখন কোনো মৃত ব্যক্তির দাফনকাজ শেষ করতেন— তখন তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবা কেরামদের বলতেন যে, ‘তোমাদের ভাইদের জন্য তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর- তিনি যেন তাকে ঈমানের ওপর অবিচল রাখেন। এবং আরো বলেন তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩২২১)

জানাযার নামাযের সঠিক নিয়ম

যিনি নামায পড়বেন তিনি সর্ব প্রথম প্রস্তুতি নিয়ে দাড়িয়ে মনে মনে জানাজার নামাজের নিয়ত করবেন। অথবা মৌখিক নিয়ত করবেন।

জানাজার নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণঃ নাওয়াইতুআন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহি তাআ’লা আরবা’য়া তাকবীরাতি ছালাতিল জানাযাতি ফারদুল কিফায়াতি আছছানাউ লিল্লাহি তাআ’লা ওয়াছ সালাতু আলান্নাবীয়্যি ওয়াদ দুয়াউ লিহাযাল মাইয়িতি এক্তাদাইতু বিহা-যাল ইমাম মোতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।

লাশ যদি পুরুষ হয় তখন নিয়তে ‘লিহাযাল মাইয়িতি’ পড়তে হবে, আর লাশ যদি নারী হয় তখন‘লেহাযিহিল মাইয়িতি’ বলতে হবে। এরপর অন্য নামাযের মত তার দুই হাত কানের উপরিভাগ পর্যন্ত তুলবে। আর এরপর আল্লাহু আকবর” বলে তকবীর দেবেন। এরপর ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখবেন। নিয়তের পর প্রথম তাকবীর বলবেন, তারপর ছানা পড়বেন

উচ্চারণঃ সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারাকাস মুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানাউকা ওয়ালা ইলাহা গাইরুকা।

ছানার পর দ্বিতীয় তাকবীর বলবেন, এরপর দরুদে ইব্রাহীম পড়বেন:

উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।

এরপর তৃতীয় তকবীর বলার পর মৃত ব্যক্তির জন্য আন্তরিক ভাবে দোয়া করবেন। প্রিয় রাসূল (ﷺ) বলেন, “যখন তোমরা মাইয়্যেতের জানাযা পড়বে তখন তার জন্য বিশুদ্ধচিত্তে দুআ করবে।” (আবু দাউদ ২৭৮৪, ইবনে মাজাহ ১৪৮৬)। মৃত ব্যক্তির জন্য যে দোয়াটি পড়বেন সেটি নিম্নরুপ

জানাজার নামাজের দোয়া বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যিনা ওয়া মায়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া ছাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলাম, ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান, বিরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমীন।

লাশ যদি কোনো শিশুর হয় তখন প্রথমোক্ত জানাযার দোয়া টি পড়বে। কিছু সলফে সালেহিন শিশুর জানাযায় নিম্নের দুআ টি পড়তেনঃ

উচ্চারণঃ-আল্লা-হুম্মাজআলহু লানা ফারাত্নাউ অ সালাফাউ অ আজরা।

দুআ করা শেষ হলে চতুর্থ তকবীর দিয়ে বুকে হাত রাখবেন। এরপর অন্যান্য নামাযড়র সালাম ফেরানোর মত ডানে ও বামে সালাম ফিরাবে। 

জানাযার নামাযে দেরি হলে কি করবেন?

অর্থাৎ জানাযার নামাযে কেউ মসবুক হলে, দেরীতে পৌছার পর ২ বা ১ তকবীর ছুটে গেলে তিনি ইমামের সাথে জামাআতে শামিল হবেন। তিনি তখন যতটা পাবেন ততটা পড়ে নিয়ে বাকী কাযা নামাজ আদায় করবেন। কারণ, প্রিয়নবী (ﷺ) এর বর্ণনায় এসেছে যে, “তোমরা জামাআতের সাথে যতটুকু নামায পাও ততটুকু পড়ে নাও এবং যতটুকু ছুটে যায় ততটুকু পুরো আদায় করে নাও।” (বুখারী ৬৩৫নং, মুসলিম ৬০২নং)। 

জানাজায় দেরি হলে কি তায়াম্মুম করা যাবে?

অনেক মুফফাসরির কেরামের মতামত জানাযার নামায শুরু হয়ে যাওয়ার পর যদি ওযু করতে যেতে হয়, তাহলে নামায ছুটে যাবে তবুও এ ক্ষেত্রে ওযু না করে তায়াম্মুম করে নামাযে শামিল হওয়ার অনুমতি নেই। কেননা, আল্লাহ তাআলা তায়াম্মুমের অনুমতি দিয়েছেন কেবলমাত্র পানি না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন।  পানি না পেলে তায়াম্মুম কর। (সুরা নিসা ৪৩ আয়াত)

এই বিষয়ে প্রিয় রাসূল (ﷺ) বলেন, মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্র অর্জনের সামগ্রী করা হয়েছে যখন তোমরা পানি খুজে পাবে না।” (মুসলিম ৫২২নং)

জানাজার নামাজ মৃতের অধিকার

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের ছয়টি অধিকার বাঁ হক রয়েছে—

এক. যখন কোনো মুসলিমের সঙ্গে দেখা হয় তখন সালাম দেবে। দুই. কোনো মুসলিম ডাকলে তখন সাড়া দেবে। তিন. সে তোমার কাছে কোন ভাল পরামর্শ চাইলে তুমি তাকে পরামর্শ দেবে। চার. কোনো মুসলিমের হাঁচি আসলে হাঁচিদাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। পাঁচ. কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তার সেবা এবং শুশ্রূষা করবে। ছয়. কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় উপস্থিত  হবে।” (মুসলিম, হাদিস : ২১৬২)

মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা – জানাজার নামাজের নিয়ম

সম্প্রতি সময় মৃত ব্যক্তির বাড়ির পক্ষ হতে গ্রাম ও আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। যদিও নিয়ম হল মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য তার আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য পেট ভরার মত খানা-পিনা প্রস্তুত করে পাঠানো। এই ব্যাপারে হাদিস শরীফে এসেছে। আব্দুল্লাহ বিন জাফর বলেন, জাফর (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর যখন তাঁর সেই খবর পৌঁছল, তখন প্রিয়নবী (ﷺ) বললেন, “জাফরের পরিবার পরিজনের জন্য তোমরা খাবার প্রস্তুত কর।

কেননা, ওদের পরিবারের নিকট এমন খবর পৌছেছে; যা ওদেরকে বিভোর করে রাখবে।” (আবু দাউদ ৩ ১৩২নং, তিরমিযী ৯৯৮নং, ইবনে মাজাহ ১৬১০নংপ্রমুখ সহীহ আবু দাউদ ১৫৮৬নং) এছাড়া ও প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালী বলেন, দাফনের পর মৃত ব্যক্তির বাড়িতে খাবার দাবার ও ভোজের আয়োজনকে এবং লোকদের জমায়েতকে আমরা জাহেলিয়াতের মাতম হিসাবে গণ্য করতাম। অর্থাৎ যে কাজ ইসলাম ধর্মে করা নিষেধ (আহমাদ ৬৯০৫নং, ইবনে মাজাহ ১৬১২নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৩০৮নং)

কিন্তু বর্তমানে সমাজ সহানুভুতি ও সহায়তাহীন একটি সমাজে পরিণত হয়েছ। বর্তমানে মৃত ব্যক্তির পরিবার খাবারের ব্যবস্থা না করলে অনেকেই খোটা দেন। নিয়ম হয়ে গেছে এই কাজটি করতেই হবে। সুনামের লোভে মাছ-মাংসের ভোজবাজিতে আত্মীয় স্বজন, জানাযায় উপস্থিত গণ, মাদ্রাসার স্টাফ ও ছাত্রবৃন্দ, পাড়াপ্রতিবেশী অথবা পুরো গ্রামকে নিমন্ত্রণ করা হয় এবং খাওয়াতে হয়, তথা কিছুতে একটু লবণ কম হলেও সবার দুর্নাম করতেও কুসুর হয় না! এমন ভোজবাজি যে জাহেলিয়াত থেকেও নিকৃষ্ট তাতে কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে?

জানাযা নামাজের ফরজ সমূহ

  • ৪ বার তাকবির দিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। প্রতিটি তাকবির এক রাকআতের স্থলাভিষিক্ত বলা হয়। জানাযার নামাজে কোন রুকু বাঁ সিজদা নেই।
  • দাঁড়িয়ে জানাযা নামাজ আদায় করা। বিশেষ ওজর ব্যতিত জানাযার নামাজ বসে আদায় করা ঠিক নয়। কোনো কিছু উপর ওঠে নামাজ পড়াও বৈধ নয়। 
  • জানাজা সঠিক হওয়ার জন্য লাশ উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক।

জানাযার নামাজের সুন্নাত সমূহ

  • আল্লাহ সুবাহানাহু তাআ’লার শানে হামদ এবং সানা পড়া।
  • প্রিয় রাসূল (ﷺ) এর উপর দরূদ শরীফ পড়া।
  • মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত কামনার জন্য দোয়া করা।

যারা জানাজার নামাজের নিয়ম সম্পর্কে জানতেন তাদের আশা করছি আর ভুল হবে না। একজন মানুষের মৃত্যুর খবর পেলে এলাকার সব লোক এবং আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব হচ্ছে মৃতের জানাজায় অংশগ্রহণ করা এবং তার স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়া।

শিক্ষা বিষয়ক আরও তথ্য

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top