বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ যেভাবে করবেন-বিস্তারিত জেনে নিন!

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বর্তমানে জনপ্রিয় মাছ চাষের পদ্ধতির নাম ৷ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন পুরো বিশ্বের অসংখ্য মানুষ ৷ আজকের নিবন্ধে আমরা এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।

বায়োফ্লক কি ? 

নির্দিষ্ট কিছু কলাকৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণে, নির্দিষ্ট একটি জায়গায় চৌবাচ্চায় মাছ চাষের আধুনিকতম পদ্ধতি হচ্ছে বায়োফ্লক বা বায়োফ্লক পদ্ধতি ৷

বায়োফ্লক সরঞ্জাম :

কৃত্রিম মাছ চাষের এ পদ্ধতিতে মাছ পালনের জন্য লাগবে চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, এছাড়াও দিতে হবে লোহার খাঁচা ও ত্রিপল, আউটলেট, পানির মান পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজন হবে টিডিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়াম টেস্ট কিড, মাছকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে প্রয়োজন পরবে মটর ও বিদ্যুৎ এর ৷

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ প্রশিক্ষণ : 

সরকারীভাবে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মকতা নিয়োগ করা হচ্ছে ৷ তাই আগ্রহী ব্যক্তিরা নিজ নিজ উপজেলা / জেলা মৎস অফিসে যোগাযোগ করে কবে, কখন, কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তা জেনে নিতে পারবেন ৷ 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ : 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ৷ কম জায়গায় তুলনামূলকভাবে বেশি মাছ চাষ করা যায় বলে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে ৷

এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে প্রথমে নির্ধারিত স্থানে ট্যাংক নির্মাণ করতে হবে ৷ ট্যাংক নির্মানের পর তা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুতে হবে ৷  অতপর সেই ট্যাংকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে ৷ সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান ও মাছ চাষের উপযোগী হয়েছে কিনা, তা বুঝার জন্য কিছু পদ্ধতি রয়েছে ৷

মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত পানির তাপমাত্রা হবে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম নয় কিন্তু ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি নয় ৷ পানি দেখতে হবে সবুজাভ বা বাদামী ৷ অক্সিজেনের মাত্রা থাকবে ৭-৮ মি. লি.৷  

এছাড়াও পানিতে পিএইচ, ক্ষারত্ব, খরতা, ক্যালসিয়াম,নাইট্রাইট,অ্যামোনিয়া,নাইট্রেট,ফসফরাস,H2H,আয়রন এর পরিমাণ থাকতে হবে যথাক্রমে ৭.৫-৮.৫৫, ৫০-১২০ মিলিগ্রাম, ৬০-১৫০ মিলিগ্রাম, ৪-১৬০ মিলিগ্রাম,০.১-০.২ মিলি, ০.০১ মিলিগ্রাম, ০-৩ মিলিগ্রাম, ০.১-৩ মিলিগ্রাম, ০.০১ মিলিগ্রাম ৷

সাথে পানির স্বচ্ছতা, গভীরতা, ফলকের ঘনত্ব,টিডিএস ও লবণাক্ততা এর মাত্রা থাকবে যথাক্রমে ২৫-৩৫ সেন্টিমিটার, ৩-৪ ফুট, ৩০০ গ্রাম, ১৪,০০০-১৮,০০০ মিলিগ্রাম, ৩-৫ পিপিটি ৷ পরবর্তীতে পানিতে ফ্লক তৈরি করে তা মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত করে নিতে হবে ৷ 

>> এলাচ চাষ পদ্ধতি ও এর উপকারিতা সহ বিস্তারিত জেনে নিন।

এই পদ্ধতিতে সাধারণত তেলাপিয়া, রুই, চিংড়ী, মাগুর, শিং, পাবদা, গুলশা ইত্যাদি মাছ আমাদের দেশে চাষ করা হয় ৷ সবচেয়ে ভালো হয় চিংড়ী ও তেলাপিয়া ৷

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এর শুরুতে বাজারে চাহিদা বেশি ও দাম বেশি এধরনের মাছ চাষ করা উচিত ৷ এতে লাভ পাওয়া যায় ৷ পরবর্তীতে ট্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে অন্যান্য মাছ চাষ করা যাবে৷ 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের উপকরণ : 

ট্যাংক তৈরি :

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে প্রয়োজন হয় ট্যাংকের ৷ ট্যাংক তৈরির দুটো পদ্ধতি প্রচলিত ৷ একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ট্যাংক তৈরি পদ্ধতি অপরটি অস্থায়ীভাবে ট্যাংক তৈরি পদ্ধতি ৷

স্থায়ীভাবে ইট,সিমেন্ট,বালু দিয়ে ট্যাংক তৈরি কিভাবে করতে হয় তা সকলেই জ্ঞাত রয়েছেন ৷ আমরা তাই জানবো অস্থায়ীভাবে ট্যাংক তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে ৷ 

অস্থায়ীভাবে ট্যাংক তৈরি করতে সবার আগে গ্রেড রড ব্যবহার করে ট্যাংকের জন্য বৃত্তাকার একটি খাঁচা তৈরি করে নিতে হবে । এরপর যে জায়গায় ট্যাংকটি বসানো হবে, সেখানে ট্যাংকের  খাঁচার পরিধি অনুযায়ী সিসি ঢালাই করে দিতে হবে । বৃত্তাকার ট্যাংকের বৃত্তের মাঝবরাবর পানি সরবরাহ করার জন্য একটি আউটলেট পাইপ বসিয়ে দিতে হবে ।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ

পাইপের কাজ শেষে খাঁচাটিকে ঢালাই করে নেওয়া মেঝের উপর ঠিকভাবে বসিয়ে ভালোকরে মাটিতে গেঁথে দিতে হবে । মেঝের মাটি শক্ত ও সমান হলে ঢালাইয়ের পরিবর্তে পরিধির সমান করে পুরু পলিথিন বিছিয়েও মেঝে প্রস্তুত করা যায়। এরপর উন্নতমানের তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে সম্পূর্ণ খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। তার উপর পুরু পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদিত করে তাতে পানি মজুদ করতে হবে।

>> শিং মাছ কাটা দিলে করনীয় কি জেনে নিন!

ট্যাংক প্রতি পানি ধারণ করা যাবে ৩০০০ লি. ৫০০০ লি. ৭৫০০ লি. ১০০০ লি. পর্যন্ত ৷ যত লিটার পানি ধারণের জন্যই ট্যাংক করা হোক তার উচ্চতা হবে সর্বোচ্চ ৪.৫ ফিট ৷ এবং ব্যাস হবে যথাক্রমে ৬, ৮, ১০ ও ১৩ ফিট ৷

পানিতে পরিমিত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এয়ার পাম্প ও ট্যাংক সংযোগ করে দিতে হবে ৷ ৮০ ওয়াটের এয়ার পাম্পের সাথে ১০ টি এয়ার স্টোন ব্যবহার করলেই ১০,০০০ লিটার পানিতে সুন্দরমতো অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে ৷ 

ফ্লক তৈরি : 

বায়োফ্লকের জন্য ফ্লক তৈরি করতে ট্যাংকের ১২:১ পানিতে আয়োডিন ব্যতিত লবণ দিতে হবে ৷ যার পরিমাণ হবে ১০০০ ppm ৷ এরপর TDS মেপে দেখতে হবে তা ১৪০০ – ১৮০০ ppm হয় কিনা । এর পর প্রেবায়োটিক, চিটাগুড়, ইস্ট দিতে হবে ৷ যা হবে ৫ ppm, ৫০ ppm, ৫ ppm অনুপাতে ৷ পানি প্রতি টনের বিপরীতে ১ লিটার, একটি প্লাস্টিকের বালতিতে নিয়ে তাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮- ১০ ঘন্টা সময় ধরে কালচার করে প্রয়োগ করতে হবে । 

এরপর দ্বিতীয় দিন প্রোবায়োটিক, চিটাগুড়, ইস্ট দিতে হবে ১ppm, ৫ppm, ১ppm করে ৷  প্রতিটি টনের জন্য ১ লিটার পানি নিয়ে কালচার করে দৈনিক তা প্রয়োগ করতে হবে ।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের খাবার : 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের মাছের জন্য নির্ধারিত খাবার ই দিতে হবে ৷ তবে এরমধ্যে থেকে পানিতে দেরিতে মিশে যায়, এমন খাবার প্রাধান্য পাবে ৷ সাধারন একটি হিসেব হচ্ছে প্রতি ছয় হাজার মাছ, পোনা থেকে বিক্রির উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকার মাছের খাদ্য বা ফিড দিতে হয় ৷

এই পদ্ধতির একটি সুবিধে হচ্ছে মাছের মলমূত্র থেকে নতুন খাবার সৃষ্টি হয় ৷ যার ফলে খাবার কম লাগে৷ 

>> কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি । একটি আদর্শ কোয়েল পাখি খামারের বৈশিষ্ট্য

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে খরচ : 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের খরচ নির্ভর করে  কতটা উন্নত ধরণের বায়োফ্লক সামগ্রী ক্রয় করা হচ্ছে তার উপর ৷ এছাড়াও সার্বক্ষণিক লোক রাখলে তার বেতনের খরচ ও রয়েছে ৷ ১০,০০০ ফিট বায়োফ্লক প্রজেক্টর জন্য আনুমানিক খরচ ধরা হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ৷ 

এছাড়াও পোনা মাছ ক্রয়, মাছের জন্য খাদ্য, অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও আনুষাঙ্গিক মিলিয়ে খরচ হবে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ৷ 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ লাভ :

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভ করা নিয়ে অনেক কথাই শুনতে পারেন ৷ তবে, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে লাভ করার জন্য ধৈর্য ধরা প্রয়োজন ৷ 

কেননা প্রথম কিস্তি মাছ চাষে তেমন একটা লাভ পাওয়া যায়না ৷ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তিতে ৩০-৪০ থেকে ৬০-৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা যায় ৷ ধীরে ধীরে ট্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে লাভের পরিমাণ ও বাড়ানো যায় ৷

শেষ কথা : 

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ৷ সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করে তা বিদেশে রপ্তানির ও সুযোগ রয়েছে ৷

বেসরকারিভাবে  প্রশিক্ষনের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র ৷ তাই, প্রশিক্ষণ গ্রহণের পূর্বে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে ৷ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top