আখ চাষ পদ্ধতি : অর্থকারী ফসল গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে আখ। আমাদের দেশের খাদ্য শিল্প ব্যবহার্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আখ মূলত চিবিয়ে খাওয়া যায়, চিনি, গুড় ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আখ চাষ পদ্ধতি
উৎস ও ইতিহাস
আখ বা ইক্ষুর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Saccharum officinarum. এটি পোয়াসি পরিবারের একটি সপুষ্পক জাতীয় উদ্ভিদ। আখ হলো বাস ও ঘাসের জাত ভাই ।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় নাটোর জেলায়। বাংলাদেশে মোট ১৫ টি সরকারি চিনিকল রয়েছে যার মধ্যে দুটি চিনিকল নাটোর অবস্থিত।
আমাদের দেশে গড়ে প্রতি বছর ০.৪৩ মিলিয়ন একর জমিতে চাষ করা হয়ে থাকে। আর গড় উৎপাদন হলো ৭.৩ টন। যদি সারা পৃথিবী জুড়ে ব্রাজিলেই সবচেয়ে বেশি আখ উৎপাদন করে থাকে।
আখ চাষ পদ্ধতি তে জমি নির্বাচন
দোআঁশ বেলে দোআঁশ এবং এঁটেল দো-আঁশ মাটি আখ চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। জমি অবশ্যই উঁচু অথবা মাঝারি উঁচু হতে হবে। জমি একদিকে বিশেষভাবে ঢালু হলে ভালো হয়।
উপযুক্ত জলবায়ু
আখ চাষের জন্য গৃীষ্ম ও অবগ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু সবচেয়ে উপযোগী। অতিরিক্ত গরম এবং অতিরিক্ত ঠান্ডা আখ চাষের জন্য ক্ষতিকর। মাঝারি ধরনের বৃষ্টি পাত আখ চাষের জন্য খুবই ভালো। তবে বৃষ্টির পরিমাণ কম হলে নিয়মিত সেচ প্রদান করা যেতে পারে।
আখের জাত
আগাম পরিপক্ক, মধ্যন পরিপক্ক, গুড় উপযোগী, বন্যা খরা লবণসহিষ্ণু, মুড়ি আখের জন্য উপযুক্ত বেশকিছু জাত আমাদের দেশে রয়েছে। আবার চিবিয়ে খাওয়ার জাত সহ বেশকিছু জাত রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আখের জাতগুলো হলো ঈ-১৬, ঈ-১৯, ঈ-১৮, ঈ-২০, ঈ-২৯, ঈ-২৬, ঈ-২৪, ঈ-২৫, ঈ-২২, ঈ-২৭, ঈ-২৮, ঈ-২০, ঈ-৩০, ঈ-৩৫, ঈ-৩২, ঈ-৩৩, ঈ-৩৪, ঈ-৩১, ঈ-৩৬, ঈ-৩৭, ঈ-৩৮, ঈ-২/৫৪, সিও-২০৮, অমৃত, কাজলা, মিশ্রিমালা, তুরাগ, বারঙ ও লতারিজবা সি।
জমি তৈরি
জমিতে আড়াআড়ি করে ৪/৫ টি চাষ দিতে হবে। মাটির ৬-৮ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত চাষ দিতে হবে। তারপর ভালোভাবে মই দিয়ে জমিকে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। আখ রোপণের পূর্বে ১.৫ থেকে ৩.৫ ফুট দূরত্বে ৯/১০ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করা বাধ্যতামূলক।
নালার ভিতরে বেসালডোজ সার ছিটিয়ে এরপর কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। নালার মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গোবর সার ও অন্যান্য রাসায়নিক সার ভালোভাবে মেশাতে হবে। আধুনিক বোর ধান চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!
বীজ নির্বাচন
রোপন উপযোগী বীজগুলো রোগমুক্ত, পরিপুষ্ট ও প্রত্যায়িত হওয়া খুবই জরুরী। উচ্চ ফলন সম্পূর্ণ বীজ বাছাই করা উচিত। জমিতে রোপণ এর জন্য পোকামাকড় মুক্ত ৮/১০ মাস বয়সের সতেজ আখের বীজ প্রয়োজন।
বীজ শোধন
৩৩ শতাংশ অথবা এক বিঘা জমির জন্য ২৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক ঔষধ নিতে হবে। তারপর ২৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক ঔষধ ২৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে তৈরি দ্রবণে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা যায়।
আখের চারা রোপন
আখ চাষ পদ্ধতি তে চারা রোপণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আখের চারা ২ প্রকারে রোপণ করা হয় জমিতে। সনাতন পদ্ধতিতে আখের বীজ খণ্ডগুলো সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করা হয়ে থাকে।
রোপণের পরে ২ ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আবার অতিরিক্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া উচিত হবে না। আবার রোপা পদ্ধতিতে আক্রমণের ক্ষেত্রে চারা তৈরি করে চারাগুলো মূল জমিতে নালার ভেতরে রোপন করা হয়ে থাকে।
আখের চারা বিভিন্ন ভাবে তৈরি করা যায়। পলিব্যাগে চারা তৈরি, বীজতলায় চারা তৈরি এবং গাছ চারা তৈরি পদ্ধতি ইত্যাদি। রোপণের পরে জমির প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
সার প্রয়োগ
মূলত আখ ফসলের সাথে সাথী ফসল চাষ করলে অতিরিক্ত সার জমিতে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আখের জমি প্রস্তুত করার সময় যে সুষম সার গুলো দেওয়া হয়। ঠিক সেগুলোর মাধ্যমে সাথী ফসলও চাষ করা যায়।
আখ চাষ পদ্ধতি তে পরিচর্যা
আখ লাগানোর পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, পানি সেচ ও নিকাশ এবং রোগবালাই দেখা গেলে সময়মতো সঠিক নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাটিতে রসের দেখা গেলে পানি সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেচ দেওয়ার পরে অবশ্যই জমিতে একবার নিড়ানি দিতে হবে। আখের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করা যেতে পারে। রসুন চাষ কিভাবে করবেন? রসুন চাষ পদ্ধতি একনজরে জেনে নিন!
রোগবালাই দমন
আখ ফসলের জমিতে জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। আর জাব পোকার আক্রমণ হলে কেরোসিন মেশানো ছাই ছিটিয়ে পোকা দমন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আবার পোকার আক্রমণের মাত্রা যদি বেশি হয়ে থাকে তাহলে তখনই অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ম্যালাথিয়ন ও ডায়াজিনন গ্রুপের যে কোন কীটনাশক স্প্রে করা যেতে পারে।
ফলন
আখের জমিতে উপযুক্ত পরিচর্যা করলে কাংখিত ফলন পাওয়া সম্ভব। সঠিক সময়ে জমিতে সুষম সার প্রয়োগ এবং পরিচর্যা ভালোমতো করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। বর্তমান বাজারে আখের চড়া দাম বিরাজ করছে।
শেষ কথা
পরিশেষে বলা যায় বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে আখ চাষের বিকল্প নেই। তাই আমাদের উচিত সঠিক আখ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে তারপর চাষ করা।