রসুন চাষ পদ্ধতি : রসুন শুধু মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু নয়। মূলত রসুন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
হাজার হাজার বছর ধরে এটি ব্যাবিলনীয়, চীন, গ্রীক, মিসরীয়, রোমান ও চৈনিক সভ্যতায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমন কি খালি পেটে রসুন খেলে স্বাস্থ্যের উপকার হয়ে থাকে।
রসুন চাষ পদ্ধতি
উৎস ও ইতিহাস
রসুন হচ্ছে একটি ঝাঁঝালো মসলা ভেষজগুন সম্পূর্ণ সবজি। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল এ্যালিয়াম স্যাটিভাম। এতে রয়েছে সালফার, থিওসেলফিনেটস এগুলো রসুনের সক্রিয় উপাদান। রসুন হচ্ছে পিঁয়াজে জাতীয় একটি সাজানো রান্নার মসলা।
বাংলাদেশের মধ্যে নাটোর জেলায় সবচেয়ে বেশি রসুন উৎপাদিত হয়ে থাকে। রসুন দক্ষিণ ইউরোপের স্থানীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাল্প ফসল গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যা ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে প্রচুর ঔষধিগুণ বিদ্যমান।
উপযুক্ত মাটি
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং সহজেই গুড়া করা যায় এমন মাটি রসুন চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম। জমিতে পানি জমবে না এরকম দোআঁশ মাটিতে নালা তৈরি করে রসুনের চাষ করা যাবে।
উর্বর এঁটেল দো-আঁশ সমৃদ্ধ মাটিতেও রসুন চাষ করা যায়। রসুন চাষের জমি এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বেশি পানিগুলো বের হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের মধ্যে রংপুর, নাটোর, দিনাজপুর, পাবনা সিরাজগঞ্জ জেলায় বেশি রসুন চাষ করা হয়।
জাত সমূহ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক অনুমোদিত কোন জাত দেখতে পাওয়া যায় না। স্থানীয় কিছু জাত আছে সেগুলো কৃষকরা চাষ করে থাকে। জাত গুলো হলো বারি রসুন-১, বারি রসুন-২, বারি রসুন-৩, বারি রসুন-৪ ইত্যাদি।
স্থানীয় জাতগুলো হল ইটালী, আউশী ইত্যাদি। তবে স্থানীয় জাতগুলো তুলনায় হাইব্রিড জাত গুলোতে রসুনের উৎপাদন অনেক বেশী হয়ে থাকে। তাই কৃষি কর্মকর্তারা বর্তমানে হাইব্রিড জাতের রসুন চাষ করার প্রতি কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
রসুন চাষ পদ্ধতি তে জমি তৈরি
প্রথমত জমিকে অবশ্যই ৪-৫ টা চাষ দিয়ে তারপর ভালোভাবে মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে মাটি তৈরি নিতে হবে। একবার সমান ভাবে জমিতে বেড তৈরি করতে হবে।
পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থার জন্য নালা তৈরি করতে হবে। এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যে জমিতে দিনের বেশিরভাগ সময় সূর্যের আলো পড়ে। পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে গাছের ফলন অধিক বৃদ্ধি পায়। যে পদ্ধতিতে পুইশাক চাষ করলে অধিক লাভবান হবেন!
বীজ বপন
রসুনের বীজ রবি মৌসুম ও গ্রীষ্ম মৌসুমে রোপন করা যেতে পারে। বছরের আগস্ট – নভেম্বর পর্যন্ত ফসল রোপন করা যায়। মূলত বীজ হিসেবে শুকনো রসুনের বাহিরের সারির কোয়া লাগানো হয়ে থাকে।
সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার এবং কোয়া থেকে কোয়ার দূরত্ব হবে ১০ সেন্টিমিটার। প্রতি হেক্টরে ৩০০-৩৫০ টি রসুনের বীজ লাগানো যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা
রসুনের জমিতে সারের তালিকা
সারের নাম | শতকপ্রতিসার | হেক্টর প্রতি সার |
কম্পোস্ট | ২০ কেজি | ৫ টন |
ইউরিয়া | ৮০০ গ্রাম | ২০০ কেজি |
টিএসপি | ১ কেজি | ২৫০ কেজি |
পটাশ | ১.৫ কেজি | ২৫০ কেজি |
জিপসাম | ৪০০ গ্রাম | ১১০ কেজি |
রসুনের জমিতে শেষ চাষের সময় জৈবসার, টিএসপি, এমওপি, জিংক এগুলি ভালোভাবে জমিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। আর জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
ইউরিয়া সার ২-৩ কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। রসুন লাগানোর পর ৩০ তম দিন ও ৬০ তম দিন যথাক্রমে ১ম ও ২য় কিস্তির ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই জনি ভিজিয়ে নিতে হবে।
আগাছা ও সেচ ব্যবস্থাপনা
মাটির অবস্থান বুঝে যদি মাটিতে রসের অভাব হয়ে থাকে তাহলে মাঝে মাঝে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেকবার সেচ দেওয়ার পর মাটি নিড়ানি দিতে হবে। নিড়ানি দিয়ে মাটিকে ঝুরঝুরে করে রাখতে হবে।
আগাছা দেখা দিলে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। কারণ আগাছা রসুন গাছের বৃদ্ধিকে তরান্বিত করে থাকে। রসুন গাছ যদি খুব ঘন হয়ে থাকে তাহলে পাতলা করে দিতে হবে। জমিকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
রসুন গাছের যে ধরনের পোকার আক্রমণ হয় তা হলো থ্রিপস, কান্ড পঁচা রোগ, পার্পল বম্নচ/বম্নাইট ইত্যাদি। এই রোগগুলোর আক্রমণের ফলে রসুনের গাছের অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে।
তাই নিয়মিত রসুনের বাগান পরিচর্যা করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগগুলো শনাক্ত করলে খুব একটা ক্ষতি হয় না। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ গুলি সনাক্ত করে সে অনুযায়ী সঠিক বালাইনাশক ব্যবস্থাপনার ফলে পোকাদমন করা সম্ভব হয়। লাল শাকের সঠিক চাষ পদ্ধতি জেনে নিন!
ফসল সংগ্রহ
রসুন গাছের পাতা যখন শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে এবং পাতাগুলো ডলে পড়ে যায় ঠিক সেই সময়ে রসুন উত্তোলন করা যাবে। গাছসহ রসুন তোলার পরে, ঠিক ঐভাবে ছায়াতে ভালো মতো শুকিয়ে পড়ে সংরক্ষণ করা যায়।
আর রসুন থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হলে আর একটু সতর্কতার সহিত ফলনগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। রসুন চাষের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ১০/১২ টন ফলন পাওয়া সম্ভব।
রসুনের পুষ্টিগুণ
রসুনের মধ্যে আছে এন্টিবায়োটিক এবং এন্টি প্যারাসাইটিক গুণাবলী। এটি শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়, ফাঙ্গাস আর প্যারাসাইট এর মোকাবিলা করতে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও রয়েছে
- পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, সেললনিয়াম জিংকের উচ্চ মাত্রা।
- স্যাপোনিন ফসফরাস, ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি-এর মাঝারি স্তর।
- সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন এবং ক্যালসিয়াম এর মত উপাদানসমূহ।
শেষ কথা
অভিযোগে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রসুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা ভালো একটি ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আসুন নিয়মিত রসুন খাই শরীরকে সুস্থ রাখি।